মঙ্গলবার ০৬ জুন ২০২৩ ||
জ্যৈষ্ঠ ২৩ ১৪৩০
|| ১৭ জ্বিলকদ ১৪৪৪
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
মায়া বেগমের বয়স ৩৮ বছর। স্বামী সাকু (৪৫), দুই ছেলে জুয়েল (২৩) ও সাব্বিরকে (১৪) নিয়ে তার সংসার। নিজস্ব বসতবাড়ি নেই। রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপাড়ায় সরকারি রেলের এক কাঠা জমির ওপর টিনশেডের কক্ষে বসবাস।
সাব্বিরের বাবা-মা দুইজনেই বাড়ির বাইরে কাজ করতে যাওয়ায় সাব্বির ঠিকমত স্কুলে না গিয়ে দুষ্টু ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াত এবং আড্ডা দিত। লাইফ প্রকল্পের পথশিশুর বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যাওয়ায় এবং তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সাব্বিরকে গত ২০১৫ সালে লাইফ প্রকল্পের পথশিশু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাব্বির এখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
স্বামী সাকু রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেন। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। গত বছর নভেম্বর মাসে কাজ করার সময় হঠাৎ ছাদ থেকে পড়ে যান সাকু। দুর্ঘটনায় তার মাথা ফেটে ও হাত ভেঙে যায়। কর্মক্ষমতা হারিয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি।
জীবিকার তাগিদে স্বামীর পাশাপাশি মানুষের বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন মায়া বেগম। তার কাঁধে অসুস্থ স্বামীর দেখভালের জন্য বাসাবাড়ির কাজেও ঠিকমত যেতে পারছিলেন না।
ফলে তার সেই কাজও বন্ধ হয়ে যায়। বেশ চিন্তায় পড়ে যান মায়া বেগম। একদিকে স্বামীর চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবস্থা করা, অন্যদিকে ছেলেদের মুখে দুবেলা দুমুঠো আহার তুলে দেয়া তার জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। তিনি আবারও বাসাবাড়িতে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি বিকালে করে বাসার সামনে পুরি, পিঁয়াজি ও বিভিন্ন ভাজাপোড়া বিক্রি শুরু করেন।
কিন্তু তার ব্যবসার পুঁজি ছিল খুবই কম। মায়া বেগম কারিতাস লাইফ প্রকল্পের বিভিন্ন সচেতনতামূলক সেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন কারিতাসের লাইফ প্রকল্প আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে পুঁজি তৈরির জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তার আবেদনের ভিত্তিতে সত্যতা যাচাই করে তাকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
সেই টাকা দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসাটি চালু রেখেছিলেন মায়া বেগম। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার আশঙ্কায় ২৬ মার্চ থেকে পুরো দেশকে লকডাউনে রাখা হয়।
পর্যায়ক্রমে ৫ বার লকডাউন বর্ধিত করা হয়। এই লকডাউনে কাজ বন্ধ, আয়হীন হয়ে পড়া, খাবারের কষ্ট ইত্যাদি সঙ্কটে সীমাহীন কষ্টে দিনযাপন শুরু করে সাধারণ মানুষ। মায়া বেগমও এই শ্রেণির একজন। যে বাড়িতে কাজ করতেন করোনাকালে সেখান থেকে তাকে ছাঁটাই করা হয়। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসাটিও লকডাউনের ফলে বন্ধ রাখতে হয়। বাসাবাড়ির কাজের টাকাটাও পেলেন না।
ফলে কাজ না থাকায় তাদের দিন কাটছিল বহু কষ্টে। মায়া বেগমের কপালের ভাঁজ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। স্বামীর ওষুধসহ পরিবারের খাবারের যোগান দেয়া সত্যিই অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সারাদিনে কোনরকমে একবেলা খেতেন। কখনো শুধু আলু সেদ্ধ খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে।
এভাবে আধপেটা থেকে কিছুদিন পার করেন মায়া বেগম। নিরুপায় হয়ে কারিতাসের দেয়া মূলধন দিয়ে ভাজা, পুরি বিক্রি করা বাদ দিয়ে বিকল্প হিসেবে বাঁশের বাতা কিনে তা বিক্রি শুরু করেন তিনি। সেই সময় বাতা বিক্রি করে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করতেন। তা দিয়ে কোন রকমে খেয়েপরে দিন পার করতে শুরু করেন। পুরো লকডাউনের সময় বাঁশের বাতা বিক্রি করেই পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন তিনি।
সে সময় কারিতাসের দে’য়া টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা তার ব্যবসার পুঁজি বাড়াতে সাহায্য করেছে। বাসাবাড়ির কাজের পাশাপাশি বিকালে বাঁশের বাতা বিক্রি ও ভাপা পিঠা বিক্রি করছেন। প্রতিদিন এই ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে ৫০০ টাকা আয় করছেন।
স্বামীর ওষুধ, সংসারের খরচ চালাচ্ছেন। সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছেন মায়া বেগমের পরিবার। পাশাপাশি কারিতাসের লাইফ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নৈতিক শিক্ষা লাভ করে ভাল ছেলে হয়ে বেড়ে উঠছে তার ছোট ছেলে সাব্বির। তার উচ্চশিক্ষার জন্য আশা সমিতিতে ১২ বছর মেয়াদী সঞ্চয়ী ডিপিএস হিসেব খুলেছেন। প্রতি মাসে সেখানে তিনি ৫০০ টাকা করে জমান।
মায়া বেগম তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘দুর্যোগকালীন সময়ে কারিতাস লাইফ প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা না পেলে হয়তো না খেয়ে দিন কাটাতে হতো। আমার এ দুর্দিনে আমার পাশে থাকার জন্য আমি কারিতাস লাইফ প্রকল্পের কাছে কৃতজ্ঞ।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়