শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১২ ১৪৩১
|| ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩০ এপ্রিল ২০২২
দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়েছেন আগেই। সেই ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। এর মধ্যেই ছেলে মাহমুদ হাবিব ওরফে হিমেল দুর্ঘটনায় চলে গেলেন গত ১ ফেব্রুয়ারি। ছেলে নেই, মায়ের বিশ্বাসই হয় না। আজও পথ চেয়ে বসে আছেন তিনি। মাঝেমধ্যেই তাঁর বেখেয়ালে মনে হয়, এই বুঝি ছেলে এসে মা বলে ডাক দেবেন।
বুধবার নাটোর শহরের কাপুড়িয়াপট্টি এলাকায় মাহমুদ হাবিবের নানার বাড়িতে গিয়ে মা মুনিরা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। ওই দিন সকালে মুঠোফোনে তাঁকে জানানো হয়েছিল রাজশাহী থেকে নাটোরে আসার কথা। ঘণ্টাখানেকের পথে কয়েকবার ফোন দিয়ে বললেন, ‘সাবধানে এসো, বাবা।’
মাহমুদ হাবিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চারুকলা অনুষদের গ্রাফিকস ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
মাহমুদ হাবিবের কথা উঠতেই মা মুনিরা আক্তার বলেন, ‘বাবা, বিশ্বাসই হয় না, হিমেল নেই। ওই দুর্ঘটনার কথা ভুলে যাই মাঝেমধ্যে।’ মাহমুদ হাবিব নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতেন। পাশাপাশি নিজের শিল্পকর্ম বিক্রি করে মাকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন।
কথাগুলো স্মরণ করে মা বলেন, ‘গত ঈদে হিমেল তাঁকে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড়, তেল-সাবান—যা যা দরকার, সব কিনে দিল। লক্ষ্মীটা আমাকে সুখে রাখতে চাইত। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল। ও হারিয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করি যেন ওর মুখটা স্বপ্নে ভেসে আসে। কিন্তু দেখি না।’
মুনিরা বলেন, ‘ও মাকে কোনো কাজকর্ম করতে দিতে চাইত না। কিন্তু ওর স্বপ্নের কথা মনে হলেই আমার কান্না পায়।’ মাহমুদ হাবিবের মায়ের চাওয়া, আর কেউ যেন দুর্ঘটনার শিকার না হন। মাহমুদ হাবিবকে নিয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি ওর সহপাঠী, সমবয়সীদের দেওয়া হয়েছে, তা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাররা বাস্তবায়ন করেন।
মাহমুদ হাবিবের বড় মামা খন্দকার আরিফুজ্জামান বাড়িতে শিশুদের খেলনার ব্যবসা করেন। মামা বলেন, ‘হিমেল যখন যেটা ধরত, সেটা ধৈর্য নিয়ে শেষ করত। একবার নাটোরে একজনের রক্ত দরকার। ও আমাকে বলল, “মামা, রক্ত দিতে হবে।” আমি গিয়ে রক্ত দিলাম। ওর অনেক যোগাযোগ ছিল। মানুষকে খুব আপন করে নিতে পারত সে।’
মাহমুদ হাবিবের মায়ের সময় কাটে স্তব্ধতায়। ছোটবেলার বাঁধাই করা ছেলের দুটি ছবি দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনা মাহমুদ হাবিবের শিল্পকর্মেও হাত বুলিয়ে দেখেন মাঝেমধ্যে। ভাইদের মুঠোফোনে থাকা ছেলের ছবি দেখেন। ভাইদের ছেলেমেয়ে নিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করেন। মাঝেমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মাহমুদ হাবিবের কবরের পাশে যান।
মাহমুদ হাবিবের কবরে একটি গোলাপ আর বেশ কয়েকটি গাঁদা ফুলের গাছ লাগিয়েছেন ছোট মামা খন্দকার আবু বকর। প্রতিদিন বিকেলে সেখানে পানি দেন মুনিরা আক্তার। গাছে দুটি গোলাপ ধরেছিল। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মা বলেন, ‘শুধু ফুলগুলো মরে গেছে, সুবাস নেই। ওর মামার লাগানো গাছে দুটি ফুল ফুটেছে। একটি ঝরে পড়েছে।’
১ ফেব্রুয়ারি রাতে মাহমুদ হাবিবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের ইট-পাথর-বালির ট্রাক চাপা দেয়। এ ঘটনায় দুই দিন উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস। চারুকলা অনুষদসহ অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের কাছে বেশ কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। দাবি ছিল, নির্মাণাধীন যে ভবনের সামনে মাহমুদ হাবিব নিহত হয়েছেন, সেটি তাঁর নামে হতে হবে। মাহমুদ হাবিবের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেসব দাবি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মাহমুদ হাবিবের মাকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আগে পাঁচ লাখ ও গত বৃহস্পতিবার আরও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা তারেক নূর প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মামলায় ট্রাকচালক ও তাঁর সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা এখন কারাগারে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মতিহার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) পলাশ বলেন, তদন্তে ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে চার্জশিট জমা দিতে পারবেন।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়