শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১২ ১৪৩১
|| ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০২১
‘গোল চাকতির মাঝে নানা রঙের উল দিয়ে করা হয় বুনন। তার নিচের দিকে উলের দড়িতে পুঁথি বা রঙ-বেরঙের পালক লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এক কথায়- ‘উইন্ড চিমস’ এর মতো দেখতে এই কারুশিল্পটি। বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনেও বেশ কাজে দেয়। সেই সাথে নানান উপকারিতা আছে এর, যা জানলে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন।’ এভাবেই ‘ড্রিম ক্যাচার’ এর বর্ণনা দিলেন কারুশিল্পী মাহাজাবীন ঐশী।
বর্তমানে ‘ড্রিম ক্যাচার’ বিভিন্ন শোপিসের দোকানে পাওয়া গেলেও অনেকেই জানেন না এর আসল ইতিহাস। তাই ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায়, উত্তর আমেরিকার ‘ওজিবস’ নামে একটি জনগোষ্ঠী প্রথম ‘ড্রিম ক্যাচার’ তৈরি করে। তাদের বিশ্বাস ছিল এই কারুশিল্পটি বিছানার ওপরে লাগালে খারাপ স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা কমে। সেই সঙ্গে ঘুমনোর সময় খারাপ শক্তির প্রভাবে কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। শুধু তাই নয়, নিজের ও বাড়ির বিভিন্ন সমস্যা দূর করে, মেলে আরও অনেক উপকার।
সখ থেকে স্বাবলম্বী হওয়া ঐশী বলেন, আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম। তিনি এলজিইডি অফিসের হিসাবরক্ষক ছিলেন। বড়ভাই ইঞ্জিনিয়ার, আর আমি বেসরকারি বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশে অনার্স ও রাবির সান্ধ্যকালীন কোর্সে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। বাবার ইচ্ছা ছিল বিসিএস দিয়ে আমি যেন সরকারি চাকরি করি। তবে ছোটবেলা থেকেই চারু-কারুশিল্পের প্রতি ছিল অন্যরকম টান। তাই বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি করতাম ড্রিম ক্যাচারসহ বিভিন্ন অর্নামেন্টসের কাজ। সৌখিনতাই এক সময় নিজেকে স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পাথেয় করে তোলে। মাত্র ৫০০ টাকায় শুরু করে দু’বছরের মাথায় আজ আমি ১০ লাখ টাকার মালিক।
উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রথমে সখের বসে ইউটিউব থেকে বিভিন্ন হ্যান্ডিক্রাফটসের ভিডিও দেখতাম। ভালো লাগতো ব্যতিক্রমী জিনিসগুলো। সেই ভালোলাগা থেকে রপ্ত করি ড্রিম ক্যাচার তৈরির পদ্ধতি। তৈরি করি বেশকিছু পণ্যও। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মেলায় বন্ধুরা মিলে স্টলে স্থান পায় ড্রিম ক্যাচার। ড্রিম ক্যাচার ব্যতিক্রমী হওয়ায় সাড়াও মেলে ব্যাপক। ক্রেতাদের চাহিদামতন পণ্য সরবরাহ করতে পারিনি। এসব ঘটনায় উৎসাহ মেলে প্রচণ্ড।
সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম আমার প্রথম বিক্রয়টিতে। আমার প্রথম ৫০০ টাকার বিনিয়োগের পণ্য ফয়সাল আজম নামের এক বড়ভাইয়ের কাছে বিক্রি করি ১০৫০ টাকায়। তিনি নিয়েছিলেন তার দোকান ডেকোরেশনের জন্য।
প্রথমদিকে ২০১৮ সালে ৫ বন্ধু মিলে ‘খাঁচা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ি। কিন্তু পরবর্তীতে একে একে সবাই চলে যায়। পরবর্তীতে শাহনাজ রশ্নি ও আমি প্রতিষ্ঠানটি ধরে রাখি। সেখানে পোশাক ও কারুশিল্পের বিভিন্ন অর্নামেন্টস বিক্রয় হয়। তার পাশাপাশি আমার নিজস্ব ‘ষোলকা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালাই। যেখানে ড্রিম ক্যাচারসহ চারু-কারুশিল্পের বিভিন্ন পণ্য রয়েছে।
তিনি জানান, ড্রিম ক্যাচার বানানোর জন্য ধাপে ধাপে কাজ করতে হয় তাকে। প্রথমে এর রাউন্ড বেজ সুতা দিয়ে মুড়ে দিতে হয়। তারপর আরেকটা সুতা দিয়ে ভেতরের বুনন রেডি করতে হয়। অনেক সময় বুননের মধ্যে ছোট ছোট পুথি দিয়ে ডিজাইন করা হয়। সর্বশেষে বিভিন্ন রঙের পুথি এবং পালক দিয়ে সাজানো হয়। প্রতিটি ধাপের শেষে আঠা লাগানো হয়, যেন এর প্রতিটি বাঁধন বেশ শক্ত হয়।
মূলত একটি ড্রিম ক্যাচার এক ঘণ্টার নিচে হয় না। তবে ডিজাইন এবং সাইজ ভেদে এটি তৈরি করতে কয়েকদিন বা সপ্তাহও লাগতে পারে। ছোট চাবির রিং ড্রিম ক্যাচারের মূল্য ১২০-১৮০ টাকা, মালা পেন্ডেন্টের জন্য ১৫০-২৮০ টাকা, এছাড়াও হাইলি ডেকরেটেড ও বিশেষ অর্ডারি ড্রিম ক্যাচারের মূল্য সাইজভেদে ৫০০-৫০০০ টাকা পর্যন্তও নির্ধারণ হয়ে থাকে।
গ্রাহকের পছন্দের বিষয়ে ঐশী জানান, ক্রেতার ডিমান্ড অনুসারে অনেক সময় ম্যাচিং করে মালা, কানের দুল, হাতের রিং, বালা ও টিপ সেট হিসেবে তৈরি করে নিতে চান। একেকটি পেন্ডেন্ট বানানোর জন্য ২০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে থাকে। আবার অরিজিনাল মুক্তার গয়না দিয়েও ড্রিমক্যাচার চান কিছু ক্রেতা। বিভিন্ন রঙ এবং শেপের অরিজিনাল মুক্তা এনে সেগুলো দিয়ে নিজের ডিজাইনে তৈরি করি মুক্তার মালা, দুল, ব্রেসলেট।
এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েন পার্ল, পটেটো পার্ল, বোরাক পার্ল, কেশি পার্ল ইত্যাদি। রঙের মধ্যে আসে সাদা, গোলাপি, পিংক, কালো, ল্যাভেন্ডার। তবে রাজশাহীবাসীকে মুক্তার তৈরি ড্রিম ক্যাচারের পরিচিতি, সৌন্দর্য ও উপযোগিতা বোঝানোর জন্য খুব কম লাভে সেল করা হয়।
সহযোগিতা ও সমস্যার বিষয়ে তরুণ এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার অধিকাংশ সেল আসে বিভিন্ন মেলা থেকেই। আর রেগুলার কাস্টমার হচ্ছেন ‘ষোলকা’ নামের অনলাইন পেজের ক্রেতারা যারা অধিকাংশই বন্ধু ও পরিচিত মানুষ।
এছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গার কিছু বড় ক্রেতাও রয়েছে তার। যারা তার পণ্যই বিদেশে দ্বিগুণ এমনকি তিনগুণ দামেও বিক্রি করেন। কারণ পাশ্চাত্যে এই পণ্যের কদর অনেক বেশি।
তিনি বলেন, সরকার যদি আমাদের মতন কারুশিল্পীদের এসব পণ্য রফতানিতে সহায়তা করত তাহলে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা সঠিক দাম পেত। সেই সাথে সরকারও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হত।
তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয়, কারুশিল্পে বিভিন্ন উপকরণের প্রয়োজন হয় যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেক্ষেত্রে সরকার যদি আমাদের বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা করত তাহলে তরুণ যুবকরা আত্মউদ্যোগী হয়ে স্বনির্ভর হতে সক্ষম হত।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে ঐশী জানান, বর্তমানে আমার বাবা ও ভাই কাজের প্রচার-প্রসারে প্রচণ্ড সহযোগিতা করছেন। বাসাতে ভাইয়ের অফিস রয়েছে। সেই অফিস আমিও ব্যবহার করে অনলাইনে যাবতীয় দাফতরিক কার্যক্রম চালাই। পূর্বের চেয়ে ক্রেতা বেড়েছে। আর তাই বর্তমানে ড্রিম ক্যাচার ও কারুশিল্পের অলংকারের পাশাপাশি কাপড় জাতীয় পণ্য নিয়েও কাজ করতে চাই।
চোষা শিল্ক, সামু শিল্ক, স্ক্রিন প্রিন্ট থ্রি-পিচ ইত্যাদি নিয়ে শিল্পের ওপর কাজ করার ইচ্ছা আছে। বর্তমানে আমার কারখানায় চারজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমার দ্বারা আরও কর্মসংস্থান হোক এটাই কাম্য, যোগ করেন তিনি।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল জানান, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। যারা তরুণ উদ্যোক্তা রয়েছে, তারা যদি আমাদের কাছে প্রস্তাব দেন তাহলে সরকারিভাবে যা যা করা প্রয়োজন সেসব করা হবে। তবে এ বিষয়ে তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়