শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ৭ ১৪৩১
|| ১১ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৩ অক্টোবর ২০২২
এক সময় সুগঠিত কৃষি ব্যবস্থা ছিল খরাপীড়িত রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বদলে গেছে বরেন্দ্রখ্যাত এই অঞ্চলের কৃষি। ভূ-গর্ভস্থ সেচের কল্যাণে বৃষ্টি নির্ভর কৃষিতে বিপ্লব আসে। রোপা আমন ছাড়াও বোরো ধানের ভান্ডার হয়ে ওঠে এই অঞ্চল।
তবে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি এবং উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত আসায় ধান উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি দপ্তর এবং কৃষকের সমন্বিত প্রচেষ্টায়।
আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-২০১৫ মৌসুমে এই অঞ্চলে ৮৭ হাজার ৩২ হেক্টর জমিতে ফলের বাগান ছিল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার ৮৫৫ হেক্টরে। লাভজনক হওয়ায় কৃষক বাণিজ্যিক ফল বাগানে ঝুঁকেছেন। এতে কমছে ধানের জমি।
আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, এক যুগ আগে থেকেই এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক ফল বাগান বাড়ছে। এক যুগে এই অঞ্চলে ধান চাষের পরিধি কমেছে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮২ হেক্টর। তবে উল্টো চিত্র উৎপাদনে। এই এক যুগের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮৫ টন।
রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিয়ে রাজশাহী কৃষি অঞ্চল। আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে এই চার জেলায় আউশ, আমন ও বোরো মিলে মোট ধানের আবাদ ছিল ১০ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৩ হেক্টর জমিতে। ওই সময় ধান উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ ৭০ হাজার ২৪৩ টন। অন্যদিকে ২০২১-২০২২ মৌসুমে এই চার জেলায় মোট ধানের আবাদ ছিল ৯ লাখ ৪০ হাজার ৫৩১ হেক্টর জমিতে। তাতে ধান উৎপাদন হয়েছে ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৩২৮ টন। ১৪ বছরের ব্যবধানে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ কমেছে। তবে এই সময়ে উৎপাদন বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮৫ টন।
২০০৮-২০০৯ মৌসুমে ধানের জেলা খ্যাত নওগাঁয় ৪ লাখ ৮০ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ ছিল। ২০২১-২০২২ মৌসুমে আবাদ এসে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬০ হেক্টরে। ১৪ বছরে এই জেলায় ধানের আবাদ কমেছে ৩৪ হাজার ৯০ হেক্টর। একই সময়ের ব্যবধানে রাজশাহীতে ৪৭ হাজার ৫৩৯ হেক্টর, নাটোরে ২২ হাজার ৯৯৩ হেক্টর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ কমেছে।
অন্যদিকে ২০২১-২০২২ মৌসুমে রাজশাহীতে ১ লাখ ৯০ হাজার ৯৬১ হেক্টর, নাটোরে ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৯৭ হেক্টর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে রাজশাহীতে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টরে, নাটোরে ১ লাখ ৮১ হাজার ১৯০ হেক্টরে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৭৩ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছিল।
ওই বছর রাজশাহীতে ৭ লাখ ৩০ হাজার ৭২২ টন, নাটোরে ৫ লাখ ৬২ হাজার ১২১ টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৫১৮ টন ধান গোলায় তোলেন কৃষকরা। আর ২০২১-২০২২ মৌসুমে রাজশাহীতে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫৩৫ টন, নাটোরে ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৯ টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৪ টন ধান উৎপাদন হয়েছে।
ধান চাষের পরিধি কমার কথা স্বীকার করেছেন নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু হোসেন। তিনি জানান, এখানকার কিছু এলাকায় কেবল একটি ফসল ধান চাষ হতো। সেটিও ছিল বৃষ্টি নির্ভর। সেচ সুবিধাসহ আধুনিক প্রযুক্তির কারণে অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আসছে। সবিধাজনক হওয়ায় ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র খ্যাত সাপাহার ও পোরশা এলাকায় আম বাগান সম্প্রসারণ হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে আম চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। একটি ফসল বাড়লে আরেকটি কমবে- এটিই সাধারণত হয়ে থাকে। ধানের জমিতে আম বাগান হওয়ায় ধান চাষের পরিধি কমছে এটা সত্য, তবে আমরা বলছি, যেসব জমি প্রকৃত ধানি, সেগুলো ধানের জন্যই রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা কৃষকদের মাঝে উন্নত ধানের জাত সম্প্রসারণ করছি। স্বল্প জীবনকাল-খরা সহিষ্ণু জাত দিচ্ছি। মাঝে তেল ও ডাল চাষ হচ্ছে। শস্যপর্যায় এবং ফসলের নিবিড়তা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আছে। আমরা বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ ও প্রকল্পের আওতায় গবেষকদের সমম্বয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। যাতে পরিবর্তিত জলবায়ুতে কৃষকরা খাপ খাইয়ে নিতে পারেন।
উপপরিচালকের এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্যে। সূত্র জানায়, গত দুই বছরেই এই অঞ্চলের চার জেলার ৭৬ হাজার কৃষক এক বিঘা জমিতে ধান চাষের জন্য প্রণোদনার আওতায় ৫ কেজি করে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানবীজ এবং ২০ কেজি করে সার পেয়েছেন।
এর মধ্যে ২০২১-২০২২ মৌসুমে ৪৩ হাজার ২০০ জন আউশ, ১ হাজার ৪০০ জন রোপা আমন হাইব্রিড এবং ১১ হাজার ৬০০ জন উফশী রোপা আমন বীজ ও সার পেয়েছেন। ওই বছরই চাষাবাদের জন্য আরও ৬৪৩ জন কৃষককে প্রণোদনার সার-বীজ দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলে চাষের জন্য উপযোগী ধানের বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করেছে ধান গবেষণা কেন্দ্রের আঞ্চলিক দপ্তর। খরা সহিষ্ণু জাত ব্রি ধান-৭১ ও পুষ্টি গুণাগুণ সম্পন্ন জিংক সমৃদ্ধ জাত ব্রি ধান-৭৪ এবং ব্রি ধান-৮৪ উদ্ভাবন করেছেন এখানকার বিজ্ঞানীরা। বোরো মৌসুমে অধিক ফলনশীল ব্রি ধান-৮১, ব্রি ধান-৮৮ এবং ব্রি ধান-৮৯ উদ্ভাবনেও এখানকার বিজ্ঞানীদের অবদান আছে। ব্রি ধান-৭৫ উদ্ভাবনেও এখানকার বিজ্ঞানীরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ব্রি রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান ড. ফজলুল ইসলাম। তিনি বলেন, ধানের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে এখানকার বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু ধানের উন্নত জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এগুলো এই অঞ্চলে চাষের উপযোগী। এখানে চাষ উপযোগী ব্রি হাইব্রিড ধান-৭ এবং ব্রি ধান-৯৮ উদ্ভাবন করা হয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী এবং নওগাঁর মহাদেবপুরে এই ধান চাষ হয়। এই ধান তুলে গোদাগাড়ীতে টমেটো এবং মোহনপুরে আলু চাষ করেন কৃষকরা। সম্প্রতি ব্রি ধান-১০২ উদ্ভাবন হয়েছে। উচ্চ মাত্রার জিংক সমৃদ্ধ এবং রোগ প্রতিরোধী এই জাতটি আগামী বোরো মৌসুমে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
কৃষকদের দিন বদলে দিয়েছে চাষের আধুনিক কৌশল ও উচ্চ ফলনশীল জাতের এসব ধান। এই তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিজয়নগর এলাকার কৃষক সাব্বির হোসেনের কথায়। সচেতন এই কৃষক জানান, উন্নত যে সকল কৃষি প্রযুক্তি ও জাত এসেছে, সেগুলো তিনি মাঠে প্রয়োগ করেছেন। ভালো ফলনও পেয়েছেন। তার দেখাদেখি এলাকার অন্য কৃষকরাও পরে এগিয়ে এসেছে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়