শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ৬ ১৪৩১
|| ১১ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০২২
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা, সংস্কৃতির পাশাপাশি এখানকার নজরকাড়া অবকাঠামোর জন্যেও এর পরিচিতি রয়েছে। স্বনামধন্য কিছু শিল্পীর সুনিপুণ কারুকাজে তৈরি বিভিন্ন স্থাপনা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে এর উৎকর্ষতা। এর পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য।
মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। এসব ভাস্কর্য মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, তুলে ধরে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দেশ গঠনে সাহস যোগায় তরুণ প্রজন্মকে। এমন একটি ভাস্কর্য হচ্ছে ‘সাবাস বাংলাদেশ’। যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত।
স্বাধীনতার জ্বলন্ত প্রমাণকে ধরে রাখার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তাজউদ্দীন আহমেদ সিনেট ভবন চত্ত্বরে শিল্পী নিতুন কুণ্ডের হাতে নির্মিত হয় এই ভাস্কর্যটি। এর উদ্বোধন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে যে কয়টি প্রতীকি ভাস্কর্য রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নান্দনিক ভাস্কর্য এটি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সেই ভয়াল রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামালার প্রতিবাদে এ দেশের তরুণরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনীর উপর। জীবন বাজি রেখে তারা দেশকে রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়েছেন ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের সেই মহান বিজয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। তারা সফল, তারা অমর। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে তাদের ওই আত্মত্যাগ।
১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানেও রাবির ভূমিকা ছিলো অনন্য। ৬৯ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের বাঁচাতে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। এরপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘাটি স্থাপন করে রাবিতে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক হবিবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউমসহ আরো অনেকে।
তারুণ্যের এই দু:সাহসের ইতিহাসকে চির অম্লান করে রাখতে শিল্পী নিতুন কুন্ডুর শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় লাল বেলে মাটি দিয়ে ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এরপর ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয় স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য ‘সাবাস বাংলাদেশ’
মূল ভাস্কর্যটি ৪০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে রয়েছে দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি। একজন রাইফেল উঁচু করে দাঁড়িয়ে আর তার বাঁ বাহুটি মুষ্টিবদ্ধ করে জাগানো। অন্যজন রাইফেল হাতে দৌড়ের ভঙ্গিতে রয়েছে।
তারা সাধারণ গ্রামীণ তরুণদের প্রতীক, যারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রাণপণে লড়ে গেছেন শত্রুদের সঙ্গে। এছাড়া দেখা যায়, একজনের পড়নে প্যান্ট, অন্যজন লুঙ্গি। যেটা মুক্তিযুদ্ধে সকল শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণের চিত্রটি ফুটে তুলেছে।
এ দু’জন মুক্তিযোদ্ধার পেছনে ৩৬ ফুট উঁচু একটি দেয়ালও দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালের উপরের দিকে রয়েছে একটি শূন্য বৃত্ত, যা দেখতে সূর্যের মতোই। ভাস্কর্যটির নিচের দিকে ডান ও বাম উভয়পাশে ৬ ফুট বাই ৫ ফুট উঁচু দু’টি ভিন্ন চিত্র খোদাই করা হয়েছে। ডানদিকের দেয়ালে রয়েছে একজন বাউল তরুণ আর একজন বাউল তরুণী, যা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের প্রমাণ।
আর অন্য দিকের দেয়ালটিতে খোদাই করা আছে মায়ের কোলে শিশু ও দুজন তরুণী, যাদের একজনের হাতে রয়েছে আমাদের জাতীয় পতাকা যেটা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়কে নির্দেশ করে।
ভাস্কর্যে আরো দেখা যায়, একজনের মধ্যে প্রচণ্ড গতিময়তা এবং অন্যজন স্থির। যেটা যুদ্ধের মাঠে অস্ত্রের লড়াইয়ের পাশাপাশি স্থির বুদ্ধির লড়াইয়ের চিত্রটি ফুটে তুলেছে। যুদ্ধ জয়ের তীব্র আকাঙ্খা ও গতিময়তা এবং স্থির যুদ্ধ কৌশলের চিত্র এই দুজন যোদ্ধার মাধ্যমে সুক্ষ্মভাবে ফুটে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলার জনজীবনের ছবি এঁকেছেন শিল্পী, বুঝিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের সম্পৃক্ততার কথা।
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বিল বলেন,সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্যের পাশেই বিশাল খেলার মাঠ রয়েছে। মাঝে মাঝেই মাঠে খেলতে যাই। এ সময় যতোবারই ভাস্কর্যটি চোখে পড়ে ততোবারই দেশের জন্য ভালো কিছু করার প্রয়োজন অনুভব করি। এই ভাস্কর্যটি দেখা মাত্রই দেশপ্রেমের বিষয়টি জাগ্রত হয়।
ইতিহাস বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী ফাহিম শাহরিয়ার বলেন, এই ভাস্কর্য বাঙালীর জাতিসত্ত্বার পরিচয় বহন করে। দেশ ভাগের পর থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে সবশেষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যতগুলো সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে তার সবগুলোতেই এদেশের তরুণরা অংশগ্রহণ করেছে এবং তারা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এ জাতি কখনো মাথা নোয়াবার নয়। এই ভাস্কর্য যেন তাদেরকেই নির্দেশ করে।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মশিহুর রহমান বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বেশকিছু ভাস্কর্য রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাবাস বাংলাদেশ। যা বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই ভাস্কর্যটি শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে, মনে সাহস জোগায়,অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্ধুদ্ধ করে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়