বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১২ ১৪৩১
|| ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ১৮ জুলাই ২০২১
শুক্রবার (১৬ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১ টা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে ট্রলিতে নামানো হলো চাঁপাইনবাগঞ্জ সদর উপজেলায় বাসিন্দা সেতারুন নেসাকে। শ্বাসকষ্টসহ করোনার লক্ষণ দেখা দেয়ায় ৬৭ বছর বয়সী এই নারীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অ্যাম্বুলেন্সে থাকার সময় তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছিলো। ট্রলিতে তোলার আগে তার মুখ থেকে সেই মাক্সটি খুলে নেয়া হয়।
অক্সিজেনমাস্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছটফট করতে থাকেন। তার এমন অস্বাভাবিক শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখে দ্রুতই আবারও মাস্ক পরিয়ে দেয়া হয়। এতে আবারও পূর্বের মতো নিস্তেজ হয়ে স্বজনদের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে শুরু করেন।
এমন দৃশ্য শুধু সেতারুন নেসার নয়- হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়ালে প্রায়শই এমন চিত্র দেখা যায়। এমনকি জরুরি বিভাগের ওয়ার্ডেও এমন চিত্রবিরল নয়। রাজশাহীতে ভারতীয় ডেল্টা সংক্রমণের পর থেকে করোনা আক্রান্ত কিংবা লক্ষণ নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে।
রামেক হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি রোগির প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ করোনা রোগি। যাদের একটা বড় অংশ গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এসব রোগিদের একটা বড় অংশের অক্সিজেন সিলিন্ডারে কাজ হচ্ছে না। প্রয়োজন পড়ছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন।
তবে বর্তমানে অতিরিক্ত রোগির চাপে অনেকের সেন্ট্রাল অক্সিজেনও কাজ হচ্ছে না। তাদের উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাইপোক্যানোলা অথবা বাইপ্যাপের প্রয়োজন পড়ছে। এখানেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাবে হাইপোক্যানোলা ও বাইপ্যাপের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে রোগিদের মৃত্যু ঝুঁকিও বাড়ছে।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, হাসপাতালে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ করোনা রোগি গুরুতর অবস্থায় ভর্তি হচ্ছেন। এসব রোগির অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল প্রায় ৬৫ শতাংশের নিচে নামছে। তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র আশা হলো আইসিইউতে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে উচ্চপ্রবাহের অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা।
যেখানে প্রতি মিনিটে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। অথবা তাদের প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, যা প্রতি মিনিটে ৭৫ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে। অথচ হাসপাতালের অধিকাংশ রোগিকে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। যেখানে প্রতি মিনিটে ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম নয়। এতে রামেকের করোনা ইউনিটের কম অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিয়ে আসা বেশিরভাগ রোগিকে মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকছে।
রামেক হাসপাতালে শনিবার (১৭ জুলাই) ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করোনা ইউনিটে ১৬ জন রোগির মৃত্যু হয়েছে। গত জুন মাসে ৩৫৪ জন মারা গেছে। এদিন করোনা আক্রান্ত ও লক্ষণ নিয়ে প্রায় ৬৬ জন রোগি ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিনিই ১৫, ১৫, ২০, ২৫ জন করে মৃত্যুবরণ করছে।
এদিন হাসপাতালে হাসপাতালে প্রায় ১১শো রোগি ভর্তি ছিলো। যেখানে করোনার ১৪ টি ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলো ৪৯৮ জন। অথচ বেড রয়েছে ৪৫৪ জনের। বাড়তি এই ৪৪ জন ওয়ার্ডের বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের হাতেগোনা দুই-একজন ছাড়া সবাই সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতার বাইরে থাকছে।
আবার হাসপাতালে করোনা রোগিদের জন্য আইসিইউ এর ২০ টি শয্যা রয়েছে। যেখানে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ জন আইসিইউ শয্যার অপেক্ষায় থাকছে। এদের প্রায় প্রত্যেকের উচ্চ মাত্রার অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে। ওয়ার্ডের বাইরে চিকিংসা নেয়া রোগি ও আইসিইউএর অপেক্ষায় থাকা রোগিদের হাইপো ন্যাজাল ক্যালোনা, বাইপ্যাথ ও অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। বাইরে থাকা এসব রোগির অক্সিজেন চাহিদা বেড়ে গেলেই বিপাকে পড়েন রোগির স্বজনরা। আগে থেকে যারা হাইপো ন্যাজাল ক্যালোনা বা বাইপ্যাথ ব্যবহার করছেন তারাও নিজের রোগির দিকে তাকিয়ে সেটা ছাড়তে চান না। এতে অনেক সময় উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেনের অভাবে রোগির মৃত্যু হচ্ছে।
জানা যায়, হাসপাতালটিতে গত সপ্তাহে ৬৯ টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সরবরাহ ছিলো। যেটা বর্তমানে আছে ৮৭ টি। যেগুলো ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। আবার এগুলো চালানোর জন্য পর্যাপ্ত আন্তরিক দক্ষ জনবলও নেয়। এতে কাঙ্খিত সুবিধা মিলছে না।
রামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী হাসপাতালের সংকটের বিষয়গুলো অস্বীকার করে জানান, রাজশাহী মেডিকেলে বর্তমানে মোট ডাক্তার রয়েছেন ৩০২ জন ও নার্স রয়েছে ১ হাজার ২০০ জন। করোনা ওয়ার্ডে ১২৫ জন ডাক্তার ও ৫২৫ জন নার্স তিন সিফটে ডিউটি করছেন। করোনা ইউনিটের প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে সবসময় একজন করে ডাক্তার থাকছেন। ডাক্তার কয়েকবার করে রাউন্ড দিচ্ছেন। তবে এটা সত্য কিছু ডাক্তার ও নার্স যারা এ পরিস্থিতিতে কিছুটা ভয় পাচ্ছে। তবে তারা অবহেলা করছে এমন অভিযোগ নেই।
তিনি আরও জানান, ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের পর করোনা রোগিদের প্রায় প্রত্যেকের অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে। করোনা রোগির চাপও কমছে না। অনেকের সেন্ট্রাল অক্সিজেনেও কাজ হচ্ছে না। হাইপোক্যানোলা অথবা বাইপ্যাপের প্রয়োজন পড়ছে। এখন এসব মেশিন চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া আগে ৪র্থ শ্রেণির ২৫০ জন কর্মচারী ছিলো। যেটা বাড়িয়ে সাড়ে তিনশ করা হয়েছে। মহামারী পরিস্থিতিতে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তারা রোগিদের সর্বোচ্চ সার্পোট দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়