বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১১ ১৪৩১
|| ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রকাশিত: ২ এপ্রিল ২০২২
সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছিলেন রাবেয়া আক্তার সাথী। বয়স তখন তেরো। ওই বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে তাকে। আর বয়স যখন সতেরো, তখন তিনি দুই সন্তানের মা। একদিকে অভাব, অন্যদিকে সংসার, মাধ্যমিকের গণ্ডি আর পেরোনো হয়নি।
কিন্তু লক্ষ্য পূরণে ঠিকই এগিয়েছেন সাথী। মায়ের দেওয়া একমাত্র গরুকে অবলম্বন করে শুরু করেন নতুন যাত্রা। আস্তে আস্তে গড়ে তোলেন খামার। তার সেই খামারে এখন ১৪টি গাভি ও ১২টি বাচুর। প্রতি মাসে ঘরে বসে সাথীর আয় এখন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
রাজশাহী নগরীর মথুরডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা সাথী এখন সফল দুগ্ধ খামারি। তার বাবার বাড়ি নগরীর উপকণ্ঠ পবার পারিলা ইউনিয়নের মাড়িয়া দক্ষিণপাড়ায়। সেখানেই গড়ে তুলেছেন ‘সাথী ডেইরি ফার্ম’। সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ১৭ বছর ধরে লেগে থাকার ফল পেয়েছেন অদম্য এই নারী।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বোনের মধ্যে সাথী ছিলেন দ্বিতীয়। ২০০০ সালে তিনি সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। বিয়ের সময় স্বামী মো. সোহাগ ছিলেন বেকার। স্যানেটারি মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু সংসারে অভাব লেগেই ছিল। বছর দুয়েকের মাথায় জন্ম হয় মেয়ে সুমাইয়া খাতুনের। এদিকে প্রিয় নানতনিকে দুধেল গাভি উপহার হিসেবে দেন সাথীর মা। সেই থেকে শুরু হয়ে আজ তা খামারে রূপ নেয়।
“সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে তিনি খামার গড়ে তুলেছেন। যেসব নারী সল্প শিক্ষিত কিংবা সংসার অসচ্ছল, তারা খামার গড়ে ভাগ্য বদলাতে পারেন। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই।
উদ্যোক্তা খামারি সাথী
সাথীর মেয়ে সুমাইয়া রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। আর ছেলে সাব্বির আহমেদ নগরীর আটকোশি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। খামারের আয়ের টাকায় সাথী এখন ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে সংসার সামলাচ্ছেন।
কিছুদিন আগে খামারেই গিয়ে পাওয়া গেল সাথীকে। খামারে কাজ করছিলেন তিনি। কাজের ফাঁকেই কথা হয় এই নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে। গৃহিণী থেকে কীভাবে পুরোদস্তুর খামারি হয়ে উঠেছেন, ঢাকা পোস্টকে শুনিয়েছেন সেই গল্প।
সাথী জানান, তার খামারে স্থায়ী কোনো কর্মী নেই। তিনি নিজ হাতেই খামারের সব কাজ দেখাশোনা করেন। দুধও দোহান করেন নিজেই। স্বামী এবং ছেলে-মেয়েরা খামারের টুকটাক কাজে সহায়তা করেন। সবার পরিশ্রমে এত দূর এসেছেন সাথী।
দীর্ঘ এই যাত্রার পথটা সহজ ছিল না জানিয়ে সাথী বলেন, শ্বশুরবাড়ি মথুরডাঙায় তার খামারে যখন ৭টা গাভি হয়, তখন বাবার বাড়ির পাশে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে খামার সরিয়ে নেন। সেখানে আরও পরিশ্রম করেন। এখন তার খামারে ১৪টি গাভি এবং ১২টি বাছুর। সব গাভি দুধ দিচ্ছে। গড়ে প্রতিটি গাভি থেকে ৭-৮ লিটার দুধ পাওয়া যায়। কিছু গর্ভবতী রয়েছে।
মাসিক আয়ের বিষয়ে সাথী জানান, দৈনিক প্রায় ১১০ লিটার দুধ পাচ্ছেন। প্রতি লিটার ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করেন। সে হিসাবে দিনে ৮ হাজার ২৫০ টাকার দুধ বিক্রি করেন। তাতে খরচ বাদ দিলে দৈনিক আয় ৫ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসিক আয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
সাথী জানান, নিজস্ব অটোরিকশায় করে প্রতিদিন দুই বেলা খামারে আসেন তিনি। দুধ দোহানের পর অটোরিকশায় করে নিয়ে যান বাড়িতে। বাড়িতে ক্রেতারা এসে দুধ সংগ্রহ করে নিয়ে যান। দুধের প্রধান ক্রেতা স্থানীয় মিষ্টি প্রস্তুতকারীরা। তা ছাড়া নির্ধারিত কিছু ক্রেতাও রয়েছেন সাথীর।
সাথী বলেন, এখন খাবারের দাম বাড়তি। অন্যান্য খরচও বেড়েছে। তবু যাবতীয় খরচ বাদে খামার থেকে আমার মাসে আয় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। সংসার ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ আসে খামার থেকেই। কিছু টাকা সঞ্চয়ও করেছি। কিছু জমিও কিনেছি খামারের আয় থেকে টাকা বাঁচিয়ে।
প্রথমে দেশি গরু ছিল। পরে উন্নত জাতের দুধের গরু কেনেন। ঋণ নিয়ে ধীরে ধীরে খামারের পরিসর বাড়ান। বর্তমানে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে এবং খামার টেকানো মুশকিল হয়ে উঠেছে বলে জানান তিনি।
কেবল গরুর খাবার জোগাতে মাত্র ৩০ টাকা কেজি দরে দুধ বিক্রি করেছেন। কিছু পরিচিত ক্রেতা ছিল। তাদের বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছে দিয়েছেন। কোনোরকম টিকে ছিলেন ওই সময়টায়। এখন আর ওই সংকট নেই জানিয়ে সাথী বলেন, করোনকালে কঠিন সময় কাটিয়েছি। লকডাউনে মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ ছিল। কেউ দুধ নেয়নি। সাধারণ ক্রেতাও পাওয়া যাচ্ছিল না। নিরুপায় হয়ে বাড়ির পাশের কাঁচা বাজারে একাই দাঁড়িয়ে দুধ বিক্রি করেছি।
দুপুরে অটোরিকশা করে খামারে গোখাদ্য আনলেন সাথীর স্বামী মো. সোহাগ। ছেলে সাব্বিরের সঙ্গে ধরাধরি করে বস্তাগুলো নামিয়ে রাখলেন খামারের শেডে। মাঝেমধ্যেই খামারের টুকটাক কাজ করেন বাবা-ছেলে।
মো. সোহাগ জানান, তার বাবা-দাদারাও একটা সময় গরু পালন করতেন। কিন্তু তার গরু ছিল না। বিয়ের পর শাশুড়ি গরু উপহার দেন। সেই থেকে গরু পালন শুরু করেন দুজনে। প্রথমে দেশি গরু ছিল। পরে উন্নত জাতের দুধের গরু কেনেন। ঋণ নিয়ে ধীরে ধীরে খামারের পরিসর বাড়ান। বর্তমানে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে এবং খামার টেকানো মুশকিল হয়ে উঠেছে বলে জানান তিনি।
স্বামীর কথার সমর্থন দিয়ে সাথী বলেন, খাবারের দাম বাড়লেও দুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে না। দাম বাড়ালেই ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আগের দামেই দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার বেশি দুধ উৎপাদনেও বাজার নিয়ে সমস্যা দাঁড়ায়। মিষ্টির কারখানায় দুধ দিলে লাভও কম আসে। তাই নিজেই মিষ্টির কারখানা গড়ে তুলবেন বলে ভাবছেন। যাবতীয় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
উল্টো স্রোতে চলা সাথী এখন এলাকার নারীদের অনুপ্রেরণা। বিষয়টি ভাবতে ভালোই লাগে তার। সাথী বলেন, এখনকার মেয়েরা পড়াশোনা শেষে চাকরির চেষ্টা করেন। চাকরি না পেলে কেবল স্বামী-সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ ব্যবসায় নামছেন এখন। কিন্তু খামারে নামছেন, এমন নারীর সংখ্যা কম। অনেকেই এই কাজটা নোংরা ভাবেন। খামার গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য। কিন্তু অসাধ্য নয়।
সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে তিনি খামার গড়ে তুলেছেন। যেসব নারী সল্প শিক্ষিত কিংবা সংসার অসচ্ছল, তারা খামার গড়ে ভাগ্য বদলাতে পারেন। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই বলে পরামর্শ দেন সাথী।
ছেলে সাব্বির আহমেদ নগরীর আটকোশি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি মায়ের খামারে সময় দেয়। বিষয়টি তার ভালোই লাগে। সাব্বিরের স্বপ্ন, ভবিষ্যতে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবা-মা তাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চায় সে।
মেয়ের সাফল্যে খুশি সাথীর মা রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, পাঁচ মেয়ের প্রত্যেককেই বিয়ের পর উপহার হিসেবে গরু দিয়েছেন। মেয়েদের সুখের কথা চিন্তা করেই গরু দিয়েছেন তিনি। বাকি চার মেয়ে যে যার মতো গরুগুলো বিক্রি করে দেন। কেবল তার গরুকে দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার উপলক্ষ করে নিয়েছেন সাথি।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়