বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১১ ১৪৩১
|| ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ৯ এপ্রিল ২০২৩
রাজশাহীর ইফতার বাজারে সুনাম ধরে রেখেছে শাহী ফিরনি ও বাটার মোড়ের জিলাপি। সেই সুনামের কিছুটা ভাগ বসিয়েছে পুরান ঢাকর ঐতিহ্যবাহী ‘বড় বাপের পোলা’। দূর-দূরান্ত থেকে এসব পণ্য কিনতে ছুটে আসছেন মানুষ।
ছয় যুগেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে নগরীর গণকপাড়া মোড়ের ‘দিল্লির শাহী ফিরনি’। ১৯৫২ সালে ভারত থেকে এনে রাজশাহীতে বিক্রি শুরু হলে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এ ফিরনি। যা এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। প্রায় ৭২ বছর ধরে রাজশাহীর ঐতিহ্য বহন করে চলা এ ফিরনির কদর রমজান মাসে বহুগুণে বেড়ে যায়।
নগরীর গণকপাড়া মোড়ের কাছেই বাটার মোড়। সেখানে নাম ও সাইনবোর্ডহীন একটি দোকানে ৬৫ বছর ধরে জিলাপির রমরমা ব্যবসা চলছে। দোকানটি বাটার মোড়ে বলে এ দোকানের জিলাপির নাম হয়ে গেছে ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’। দোকানটিতে রসে টইটম্বুর আর মচমচে জিলাপির টানে সারা বছরই ভিড় লেগে থাকে। রমজানে ইফতারের জন্য এ ভিড় কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে ছোট্ট দোকানটির ভেতরে গিজগিজ করছে মানুষ। গরম-গরম জিলাপি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হচ্ছে। কড়াই থেকে জিলাপি তোলার ফুরসত পাচ্ছেন না কারিগর। ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। এদিকে নতুন আকর্ষণ হিসেবে রাজশাহীতে যুক্ত হয়েছে রহমানিয়া প্লাসের বাপের বড় পোললাই খাই। ঢাকায় বেশ সুনামের কারণে রাজশাহীর ফিরনি ও জিলাপির পাশে নিজের জায়গা করে নিয়েছে বড় পোলাই।
দিল্লির শাহী ফিরনি কিনতে আসা আব্দুল আমিন বলেন, প্রতিবছরই এখান থেকে ফিরনি কিনে নিয়ে ইফতার করি। এবারও তিন-চার দিন নিয়ে গেছি। ঐতিহ্য এবং স্বাদের কারণে প্রায় প্রতিদিন ইফতারের সঙ্গে এ শাহী ফিরনি কেনা হয়। এখন কোনো বছর ফিরনি না কিনলে সেবার মনে হয় রোজায় হয়নি।
সাহেব বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. আরিফ। তিনিও এসেছেন ফিরনি কিনতে। তিনি বলেন, প্রায় দুই যুগ ধরে ইফতারের মেন্যুতে অন্যান্য খাবারগুলোর সঙ্গে এ ফিরনি রাখতে হয়। প্রতিদিন আসি। খেয়ে মজা পাই। তবে এর দাম বেড়েছে অনেক।
দিল্লির শাহী ফিরনি বিক্রেতা রিয়াজ আহমেদ খান জানান, ১৯৫০ সালে তার দাদা আনিছুর রহমান খান এ হোটেল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর তিনি ভারত থেকে ‘দিল্লির শাহী ফিরনি’ রাজশাহীতে এনে বিক্রি শুরু করেন। করেন। তখন এক বাটি ফিরনির দাম ছিল চার আনা। শুরু থেকেই প্রতিটি বাটিতে ১০০ গ্রাম করে ফিরনি দেওয়া হয়। এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা। বর্তমান বাস্তবতা অনুযায়ী যা খুবই কম।
তিনি আরও বলেন, দাদার মৃত্যুর পর তার বাবা আব্দুল বারি খান এ ব্যবসার হাল ধরেন। তার মৃত্যুর পর এখন ব্যবসা আমি দেখাশোনা করছি। শাহী ফিরনি ছাড়াও এ হোটেলের শাহী হালিম, শামি কাবাব, কাঠি কাবাব, শিক কাবাব, পেঁয়াজু, বেগুনি, কচুরি ও জিলাপি বেশ জনপ্রিয়।
এক টাকা চার পয়সা বেতনে প্রায় ৪৭ বছর আগে রহমানিয়া হোটেলে ফিরনি তৈরির কারিগর হিসেবে চাকরি শুরু করে মো. চাঁন। তিনি জানান, দুধ, পোলাওয়ের চালের গুঁড়া, কিশমিশ, চেরি ফল ও চিনির সঙ্গে নানা ধরনের মসলা মিশিয়ে তৈরি হয় এ ফিরনি। পরে মাটির একটি পাত্রে জমিয়ে রেখে সেটি বিক্রি করা হয়। যুগের পর যুগ ধরে স্বাদের ঐতিহ্য বহন করে আসছে দিল্লির এ শাহী ফিরনি।
এবার রমজানে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চারশত বাটি ফিরনি বিক্রি হচ্ছে। তবে ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে বিক্রি তত বাড়বে।
ফিরনির দোকান থেকে দুই চার পা এগোতেই দেখা মিলবে বাটার মোড়ে জিলাপির দোকান। সেখানে পা ফেলার সময় নেই। জিলাপি উঠতে উঠতেই নিমিষে বিক্রি শেষ। আবার গরম অপেক্ষা জিলাপির জন্য।
জিলাপি কিনতে আসা সবুজ হোসেন বলেন, ৩০ বছর বয়স থেকে জিলাপি খেয়ে আসছি। ইফতারে এ জিলাপি না হলে মনে হয় ইফতারিটা পরিপূর্ণ হয় না।
জানা যায়, বাটার মোড়ের জিলাপির দোকানের যাত্রা শুরু পঞ্চাশের দশকে। নাম রানিবাজার রেস্টুরেন্ট। তখন মালিক ছিলেন সোয়েব উদ্দিন। রানিবাজার রেস্টুরেন্ট নামের সাইনবোর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর সাইনবোর্ডের দরকার পড়েনি। বাটার মোড়ের জিলাপির নামে পরিচিতি পায় দোকানটি। তখন এ দোকানের একমাত্র কারিগর ছিলেন যামিনী সাহা। পরে যামিনী সাহার কাছ থেকে জিলাপি বানানো শিখে যান তার ছেলে কালিপদ সাহা। ১৯৮০ সালে বাবার মৃত্যুর পর প্রধান কারিগর হন কালিপদ সাহা। কালিপদের হাতে তৈরি এ জিলাপি এক সময় রাজশাহী শহরের মানুষের কাছে ‘কালিবাবু’ নামেও পরিচিত হয়ে ওঠে। কালিপদ সাহা মারা যান ২০১৭ সালে। এখন তার রেখে যাওয়া দুই শিষ্য সাফাত আলী ও শফিকুল ইসলাম জিলাপি বানাচ্ছেন। বর্তমানে দোকানের মালিকানায় শোয়েব উদ্দিনের ছেলেরা। তাদের মধ্যে দোকানটি দেখাশোনা করেন মো. শামীম।
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দাম বাড়ানো হলেও মান ধরে রাখা হয়েছে। গত বছর রোজার সময়েও ১৪০ টাকা কেজি দরে জিলাপি বিক্রি হয়েছে। এখন প্রতি কেজির দাম ১৮০ টাকা রাখা হচ্ছে। জিলাপি তৈরির সব উপাদানের দাম বেড়েছে। এ কারণে নিরুপায় হয়ে দাম বাড়িয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এখানকার কারিগররা মান ধরে রেখে বছরের পর বছর জিলাপি তৈরি করে আসছেন। স্বাদেও কোনো হেরফের নেই। তাই সাধারণ সময়ে দোকানটিতে দিনে ৮০-৯০ কেজি জিলাপি বিক্রি হলেও রোজায় তা বেড়ে ২০০ কেজি ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে রাজশাহীতেও মিলছে ঢাকার চকবাজারের জনপ্রিয় ‘বড় বাপের পোলা’। ইফতারের জনপ্রিয় এ খাবারটি নগরীর অলোকার মোড় এলাকার রহমানিয়া প্লাস রেস্টুরেন্টে পাওয়া যাচ্ছে। ‘বড় বাপের পোলা’ কিনতে ক্রেতারা ভিড় করছে। নতুন এ খাবারটির ৫০ ও ১০০ টাকা প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে।
‘বড় বাপের পোলা’ কিনতে এসেছেন মৌসুমী ইসলাম। তিনি বলেন, আমি আগে ঢাকায় ছিলাম। তখন খেয়েছি। বাড়িতে অনেক দিন গল্পও করেছি। এখন রাজশাহীতে পাওয়া যাচ্ছে তাই এখান থেকে কিনতে এসেছি।
রহমানিয়া প্লাসের স্বত্বাধিকারী রেজুয়ান আহমেদ খান ভুলু জানান, প্রথম রমজান থেকেই ইফতারে ‘বড় বাপের পোলা’ বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা ভালো ভিড় করছে। গত বছর ভালো সারা পেয়েছি। এবারও ভালো বিক্রি হচ্ছে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়