শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||
জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১
|| ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারি ২০২২
যে বয়সে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ও খেলাধুলা-হইহুল্লোড় বা আনন্দ-ফুর্তিতে থাকার কথা, সে বয়সে কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত সানবীর হােসাইন। নির্ভার শৈশবে যেখানে মেতে উঠবে দুষ্টুমিতে, সেখানে ভার্চুয়াল জগৎকে বেছে নিয়েছে সঙ্গী হিসেবে। ইতােমধ্যে কম্পিউটারের অর্ধশতাধিক প্রােগ্রাম আয়ত্ত করাসহ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসে নিজেকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। পাবনার ঈশ্বরদীর বাঘইল শহীদপাড়ার ১৩ বছর বয়সী এই কিশােরের মাসিক আয় এখন লক্ষাধিক টাকা। করােনায় যখন তার বাবা ব্যাংকঋণ নিয়ে দিশেহারা, ঠিক সে সময় ছােট্ট সানবীর বাবার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সানবীর রাজশাহীর প্যারামাউন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। কবির হােসাইন-সুরভী হােসাইন দম্পতির বড় সন্তান সানবার। পরিবারে তারা তিন ভাই-বােন। আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসা কুড়াচ্ছে সানভীর। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, তুরস্কের মতাে দেশের শত শত বায়ার-সেলারের সঙ্গে দক্ষতা দিয়ে বিজনেস কনফারেন্স মিটিং আয়ােজন করে যাচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানি ড্যাৰজন প্রাইভেট লিমিটেড, যুক্তরাষ্ট্রের তােরাে ভেঞ্চার এলএসসি, তুরস্কের মেডিকেল কোম্পানি টর্নোস টর্সেনসজসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে ঘরে বসে জব করে সে। পাশাপশি বিমানের ওপরও সে দক্ষতা অর্জন করেছে। মিউজিক চর্চাও করে। ব্যবসায়ী বাবা ও গৃহিণী মায়ের প্রথম সন্তান সানভীরের ছােটবেলা থেকেই কম্পিউটারইন্টারনেটের প্রতি ব্যাপক আকর্ষণ ছিল। তখন থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রতি অন্য রকম ভালাে লাগা আজ তাকে বিশ্বের অন্যতম কিশাের উদ্যোক্তা হতে সহযোগিতা করেছে। চার শতাধিক ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কাজ করছে সানবীর। সানবীর ট্রেডিং' নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সে। এ নামেই ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে পরিচিত সানবীর। করপােরেট, ই-কমার্স, ই-লার্নিং, রিয়েল এস্টেট ও রেট-একারসহ স্ট্যাটিক ও ডায়নামিক ওয়েবসাইট ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট করে থাকে। এইচটিএমল, জাভাস্ক্রিপ্টি, সিএসএস, বুটস্ট্রাপ, এসএএসএস, জেকোয়ারি পিএইচপি, মাইএসকিউএল ডেটাবেইস, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশান, বাগ ফিক্সিং, সাইবার সিকিউরিটিসহ বিভিন্ন প্রােগ্রামিং ভাষা এবং ফ্রেমওয়ার্কসহ অর্ধশতাধিক কম্পিউটার প্রােগ্রামিং বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে সানবীর। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসে পিপিই, মাক, হ্যান্ডয়াস, ভ্যান্টিলেটর, ফুয়ােল পেট্রোলিয়াম, ইউরিয়া সার, ধাতু, লােহা, পীতলের কার্প, বুট, ব্যাগ, সানফ্লাওয়ার ওয়েল, রেডিমেড গার্মেন্টস, বিটুমিন (রাস্তার পিচ), এলপি গ্যাস, রিয়েল এস্টেট বিজনেস নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার সখ্য। তার সঙ্গে আলাপকালে সানবীর হােসাইন বলে, “ছোটবেলা থেকেই আমার মা-বাবার অনুপ্রেরণা আমাকে কম্পিউটারের দিকে ধাবিত করে। শুরুতে মা বকাঝকা করতেন। কিন্তু বাবা আমাকে সাহস দিতেন। তখন থেকেই আমি মূলত মাউস নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। তারপর থেকে ইউটিউবে টিউটরিয়াল দেখে দেখে কম্পিউটারের যাবতীয় কাজ শিখে আয়ত্ত করে নিই। এখন আমি নিজেই ওয়েবসাইটের জটিল বিষয় সমাধানের টিউটরিয়াল তৈরি করে ইউটিউবে নিয়মিত আপলােড করি।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসের বিষয়ে সানবীর বলে, “২০২০ সালের মার্চে করােনার শুরু থেকে যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে, তখন বাবার ট্রেডিং বিজনেসের হাল ধরি। গুগল সার্চের মাধ্যমে মেইচেউং টেক ট্রেডিং নামে চায়নি একটি কোম্পানির সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর কানাডিয়ান প্রফেসর ওমর লায়লানির হাত ধরে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসে পথচলা শুরু হয় আমার। তারপর থেকেই এই বিজনেসের শিক্ষা লাভ করি। তাদের সঙ্গে বিজনেস কার সূত্রপাত মূলত তখন থেকেই হয়। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পিপিই মাস্ক, হ্যান্ডগ্নাবস, ভ্যান্টিলেটর নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথম থেকেই ব্যাপক সাড়া পাই। এরপর বিক্রি শুরু করি। আন্তর্জাতিক মানের চার শতাধিক মানুষের সঙ্গে ব্যবসায়িক যােগাযােগ করে থাকি। প্রায় ২০ থেকে ২৫টি বিশ্বের দামি ব্যান্ড আইটেম নিয়ে কাজ করছি এখন। বাংলাদেশি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠান গােইনােভিয়ার টেকনােলজির প্রধান নির্বাহী | কাহাফিল উরা বলেন, সানবীর শুরুতে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ
করে। এরপর নিজেই একজন দক্ষ শিক্ষক হয়ে যায়। সানবীর এতটাই মেধাবী ও তীক্ষ বুদ্ধির অধিকারী যে খুব সহজেই জটিল বিষয়গুলাের সমাধান করতে পারে।
করােনার ছুটিতে মাত্র তিন মাসে সে বিমানের ককপিটের ড্যাশবাের্ডের সুইজিংয়ের বিভিন্ন কাজ রপ্ত করে। ই-কমার্সের যাবতীয় বিষয় সে শিখে ফেলেছে। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত তার বিজনেস পার্টনার মাইনুদ্দিন তুষার দ্বীন বলেন, সানবীর খুবই মেধাবী ও দক্ষ কিশাের। বায়ার-সেলারদের সঙ্গে খুব সহজেই যােগাযোগ করে পণ্য বিক্রি করতে পারে। খুব সহজেই তাদের নিয়ে বিজনেস কনফারেন্স মিটিং অ্যারেঞ্জ করতে পারে। আমি অনেক কিছুই জানতাম না। বিজনেস সম্পর্কে অজয়
ছিলাম। সানবীরের থেকে অনেক কিছু শিখছি।। তুরস্কের ব্যবসায়ী ইঞ্জিনিয়ার গাের্কান সানবীরের বিষয়ে বলেন, এত ছােট বয়সেই সে তার কাক্ষিত যােগ্যতার জায়গায় নিয়ে গিয়েছে বলে আমি মনে করি। সে তার ট্রেডিং বিজনেসের কমিশন লাভ করে। আমাদের এপের মধ্যে সবচেয়ে ছােট হওয়ায় সবাই তাকে স্নেহ করে থাকি। তাকে নিয়ে আমরা খুব গর্ব করি। সানবীরের মা সুরভী হােসাইন বলেন, সানবীর প্রথম যখন মােবাইল-কম্পিউটার নিয়ে দিনরাত পড়ে থাকত, আমি বকাঝকা করতাম। এখন দেখছি ছেলে গতানুগতিক কোনাে বাজে আডডায় না গিয়ে অনেক বড় ক্যারিয়ার অর্জন করছে। এটা এখন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সানবীরের বাবা কবির হােসাইন বলেন, ছােটবেলা থেকে ছেলেকে অন্যদের সঙ্গে তেমন মিশতে না দিয়ে কম্পিউটারের দিকে ধাবিত করেছি। ছেলেকে হেফসবুক, ইন্টারনেট ও গ্যামস খেলা থেকে দূরে রাখতে তাকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসের সঙ্গে যােগাযােগে উদ্বুদ্ধ করেছি। অনেক বাবা-মাকে দেখেছি সন্তানদের গেমস খেলার দিকে মনােযােগী করে। এটি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সন্তানদের লেখাপড়া ও খেলাধুলার দিকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের কম্পিউটার-ভিত্তিক অনেক কোডিং (প্রােগ্রাম) শেখর সাহটে যেতে দিন। আমার ছেলেকে নিয়ে এখন আর পেছনে তাকাতে হবে না। সে কম্পিউটারের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতে পারে। ছেলেকে নিয়ে এখন অনেক বড় স্বপ্ন দেখছি। ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পিএম ইমরুল কায়েস বলেন, এমন প্রতিভাবান কিশাের রাষ্ট্রের জন্য বিরাট সম্পদ। সানবীরকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে সম্মানিত করবে। তার জন্য সরকারিভাবে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়