শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১৪ ১৪৩১
|| ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
প্রকাশিত: ৫ মার্চ ২০২৪
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনে রাজশাহীর উদ্দেশে যাত্রা করি। রেলের অব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘদিন রেলভ্রমণ করি না। দীর্ঘ বিরতির পরে রেলে ভ্রমণ করে মনে হলো আমার দেশটা সত্যি এগিয়ে যাচ্ছে।
এত দিন ধরে শুনে এসেছি—৯টার ট্রেন কয়টায় যাবে! ট্রেনের সময়সূচি অধিকাংশ সময়ই ঠিক না থাকার করণে এটি একটি প্রবাদবাক্যের মতো দাঁড়িয়েছিল। এই অপবাদ থেকে দ্রুতই আমরা বেরিয়ে আসছি মনে হলো। শিডিউল অনুযায়ী ১টা ৩০ মিনিটে কমলাপুর থেকে ট্রেন ছাড়লেও বিভিন্ন স্টেশনে অন্য ট্রেনকে ক্রসিং দিতে গিয়ে রাজশাহীতে খানিক বিলম্ব। তবে ফেরার পথে বনলতা এক্সপ্রেসটি রাজশাহী থেকে সকাল ৭টায় ছেড়ে দুপুর পৌনে ১২টায় কমলাপুরে এসে পৌঁছেছে, যা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। শুধু তাই নয়, ট্রেনে পর্যাপ্ত লাইট, ফ্যান, প্রবীণদের জন্য হাই কমোড, একটি মানসম্মত ওয়াশরুমে যা যা থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সবই ছিল। বসার সিটগুলোও ছিল মানসম্মত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ১৫ নভেম্বর ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ আমলে এর জন্ম। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে অনেক খাতের উন্নয়ন ঘটলেও এই খাতের কোনো উন্নয়ন হয়নি। অথচ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে রেলের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই রেল নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু দেশের রেলের অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তার অভাব, দুর্নীতি, সর্বোপরি জবাবদিহির অভাবে রেল সেই জায়গা ধরে রাখতে পারেনি। রেল দুর্ঘটনা একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দুর্ঘটনায় বহু প্রাণহানি ঘটছে। সম্প্রতি রেলে বেশ কয়েকটি নাশকতার ঘটনাও ঘটেছে। এতে রেলের ব্যাপক ক্ষতিসহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশে ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই। অনুমোদিত ১ হাজার ৪৯৫টির মধ্যে ৬৩২টিতে গেটম্যান নেই। গেটম্যান ছাড়া রেলওয়ে ক্রসিং চলা কত বড় ঝুঁকি, ভাবা যায়? এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এগুলো যাদের দেখার কথা তারা দেখছেন না। রেলের ভাড়া বাসের চেয়ে তুলনামূলক কম ও নিরাপদ এবং আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য রেলে ভ্রমণে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। রেল দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশন প্রদত্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১১৬টি। এই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ১ হাজার ৩৪৫ জনের। আহত হয়েছে ১ হাজার ৩০২ জন। গত বছরের ২৩ অক্টোবর ভৈরবে এগারসিন্দুর গোধূলি এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় প্রায় ২০ জনের প্রাণহানি এবং আহত হন ২০০ জনেরও অধিক বলে জানা যায়।
রেলের টিকিট পাওয়া একটা দুরূহ ব্যাপার। ট্রেনে সিট খালি থাকলেও লাইনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বলা হয় টিকিট শেষ। কালোবাজারিরা সক্রিয়। ইদানীং অনলাইনে টিকিট করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও জটিলতার সন্মুখীন হতে হয়। ট্রেনে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা এখনো ঘটছে। লোকবলের অভাবে বেশ কিছু স্টেশন প্রায়ই বন্ধ দেখা যায়। জানা যায়, এক টাকা আয় করতে রেলের ব্যয় হয় ৬ টাকা! ২০২০-২১ অর্থবছরে রেল আয় করেছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা, কিন্তু এই সময়ে ব্যয় করতে হয়েছে ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও রেল ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা আয় করতে ব্যয় করেছে ৫ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। (২৩.০১.২২ দৈনিক যুগান্তর) এভাবে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকশান দিয়ে রেল চলছে। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রেলের নাশকতার ঘটনার পরে ২ হাজার ৭০০ অস্থায়ী আনসার নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এসব আনসার রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করবেন। এছাড়া রেলপথে নাশকতা কিংবা দুর্ঘটনার খবর তাত্ক্ষণিকভাবে জানার জন্য রেল স্টেশন, ট্রেনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) ক্যামেরা বসানোর কথা জানা গেছে। নাশকতা এড়াতে কয়েকটি ট্রেন বন্ধ করা হয়েছিল এবং রাতে ট্রেন চলাচলের গতি ৯০ কিলোমিটার থেকে ৬০ কিলোমিটারে চালানো হচ্ছে। রেলের উন্নয়নের জন্য সরকার বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের ট্রেন আমদানি করলেও এগুলো অদক্ষতা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে থাকছে। অথচ পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, ‘বিশ্বমানের রেলের যুগে বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম ও অত্যাধুনিক রেলপথের নাম ঢাকা-ভাঙ্গা-যশোর রেলপথ। বিগত রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘রেলে স্বর্ণযুগ আসছে’। কিন্তু তিনি সেটা বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। প্রতিবছর রেলের বরাদ্দ বাড়লেও বাড়ছে না এর গতি এবং কাঙ্ক্ষিত সেবার মান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এত বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেও যাত্রীরা সঠিক সেবা পান না। রেলে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও পুরো রেলপথ ঝুঁকিতে রয়েছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, বর্তমানে ৪৯৩টি স্টেশন এবং ৩৬৭টি যাত্রীবাহী ট্রেন সচল রয়েছে। এসব ট্রেনের অধিকাংশেরই অবস্থা কম-বেশি সমান। দেশের সার্বিক উন্নয়নে রেলকে আধুনিক ও নিরাপদ ভ্রমণের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। রেলওয়ের ওয়ার্কশপগুলোতে নতুন নতুন ইঞ্জিন ও বগি তৈরি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এতে করে একদিকে যেমন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে রেল থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কয়েক গুণ বাড়বে। রেলকে আর লোকসানের মুখে পড়তে হবে না। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টির দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে।
এর সঙ্গে রাজশাহী শহরের নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে বলা প্রয়োজন। বলা হয়, রাজশাহী শহর লেখাপড়ার শহর। পুরো শহরেই রয়েছে স্কুল, কলেজ আর একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে রুয়েট, মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল বিশাল এলাকাজুড়ে মনোরম পরিবেশে। বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালিসহ আমবাগানে ভরা চত্বরটি। এখানে একটি রাস্তা রয়েছে, যাকে ‘প্যারিস রোড’ বলা হয়। এই রাস্তাটা দিয়ে চলাচল করলে খুব গর্ব অনুভব করতাম। মনে হতো না আমাদের দেশের কোনো রাস্তা দিয়ে চলছি। রাস্তার দুই ধারে একই ধরনের সারি সারি গাছের সমারোহ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নয়নাভিরাম মতিহারের সবুজ চত্বর। হলে থাকার কারণে শহরে খুব বেশি যাওয়ার প্রয়োজন হত না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াশোনা করেছি, তখন শহরটা এত ছিমছাম, টিপটপ ছিল না। এবার গিয়ে রাজশাহী শহরটাকে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছিল। উন্নয়নের ছোঁয়ায় আলোকিত এক শহর! মানুষের সদিচ্ছা থাকলে যে কোনো কাজই সফলভাবে করা যায়। উত্তর জনপদের রাজশাহী শহরকে একটা রোল মডেল হিসেবে ধরে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়ন করা খুব সহজ। রাজধানী ঢাকা শহরের অবস্থা করুণ। এখানে শুধু ভিআইপি রোড ছাড়া অন্য রোডগুলো ইট আর কংক্রিটে ভরা, যানজট। এক কথায়, রাজধানী শহরটা বসবাসের প্রায় অযোগ্যই বলা যায়। এখানে প্রাণের কোনো ছোঁয়া নেই। রাজশাহী এর ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়