রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||
জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১
|| ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ২১ আগস্ট ২০২১
বিভীষিকাময় রক্তাক্ত ২১ আগস্ট। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করার নারকীয় গ্রেনেড হামলার ১৭তম বার্ষিকী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে এ নারকীয় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে।
বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ আরও ২৪ জন নিহত হন। এছাড়া এই হামলায় আরও ৪০০ জন আহত হন।
আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। আওয়ামী লীগের দাবি, দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে সংগঠনের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ওই ঘৃণ্য হামলা চালায় ঘাতকচক্র। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়ি লক্ষ্য করেও চালানো হয় ৬ রাউন্ড গুলি। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি আহত হন, তার শ্রবণশক্তি চিরদিনের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সেদিন যা ঘটেছিল : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ নেতারা। দলের প্রধান এবং তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা ছিলেন ওই সমাবেশের প্রধান অতিথি। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে রাস্তায় উত্তর-পূর্ব কোণে একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। বিকাল ৩টা থেকে দলটির কিছু মধ্যম সারির নেতা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন।
বিকাল ৪টার দিকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা তখনও এসে পৌঁছাননি। দলের নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় ছিলেন।
বিকাল ৫টায় শেখ হাসিনা এসে সভাস্থলে পৌঁছান এবং ট্রাকে তৈরি মঞ্চে ওঠেন। শেখ হাসিনা বক্তব্য শুরু করেন ৫টা ২ মিনিটে। তিনি ৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক ছেড়ে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই দক্ষিণ দিক থেকে তাকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড ছোড়া হয়।
গ্রেনেডটি ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনা সেই মঞ্চেই বসে পড়েন। সঙ্গে থাকা অন্য নেতারা এ সময় মানবঢাল তৈরি করে তাকে রক্ষা করতে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। প্রথম গ্রেনেড হামলার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রাক লক্ষ্য করে একই দিক থেকে পরপর আরও ২টি গ্রেনেড ছোড়া হয়।
এ সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা দেহরক্ষী পুলিশ সদস্যরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালান। বিকাল ৫টা ২২ মিনিট থেকে এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে অন্তত ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ও দেহরক্ষী শেখ হাসিনাকে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে তার বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলতে যান। তখন সেই গাড়ি লক্ষ্য করেও পরপর গুলি চালানো হয়। এমনকি তার গাড়ির চাকায় গুলি করা হলেও চালক দক্ষতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
ওই সমাবেশে তখন শেখ হাসিনার পাশে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, নেত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনলাম। প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, এদিক-ওদিক তাকালাম। চারপাশে শুধু চিৎকার শুনতে পেলাম।
ওই সময় সেখানে থাকা দলের আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, মৃত্যুর আগে সেদিন যেন আমি কেয়ামত দেখেছি। দফায়-দফায় বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীরা প্রথমে বুঝতে পারেননি যে এটি ছিল গ্রেনেড হামলা। অনেকেই ভেবেছিলেন বোমা হামলা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করেছিলেন।
গ্রেনেড হামলার পর গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নেতাকর্মীরা জীবন দিয়ে আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন। আমার নেতাকর্মীরা সবাই আমাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলেন যে, তাতে অনেকেই ইনজিউরড (আহত) হয়েছেন। তাদের রক্ত এখনো আমার কাপড়ে লেগে আছে। আমার নেতাকর্মীরা তাদের জীবন দিয়েই আমাকে বাঁচিয়েছেন।
২১ আগস্টের হামলার সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আহতদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে পুলিশ উল্টো তাদের হেনস্থা করেছে। সে সময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি সরকারের ভূমিকা নিয়েও নানা বিতর্ক এবং প্রশ্ন রয়েছে। ঘটনার পর শেখ হাসিনা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা যখন আহতদের সাহায্য করতে গেছে, ঠিক সে সময় পুলিশ উল্টো টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ ও তাদের গ্রেফতার করতে শুরু করেছে।
তিনি বলেন, আহতদের সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে পুলিশ যখন উল্টো টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ ও গ্রেফতার করতে শুরু করল, তখন বুঝতে পারা যায়, এ ঘটনা তাদের মদদে হয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, গ্রেনেড হামলার সেই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে।
শেখ হাসিনাকে হত্যার সব চেষ্টাই হয় : গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে ছয়টি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারার চিহ্ন এবং বুলেটের আঘাতে পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির দুটি চাকা সেটাই প্রমাণ করে।
তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থাসম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই সেদিন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে তার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, গ্রেনেড আক্রমণ ব্যর্থ হলে নেত্রীকে হত্যার বিকল্প পন্থা হিসেবে বন্দুকধারীদের তৈরি রাখা হয়। আর এই বন্দুকধারীরাই খুব হিসাব কষে নেত্রীর গাড়ির কাচে গুলি চালায়।
এই গুলি বুলেটপ্রুফ কাচ ভেদ করতে ব্যর্থ হলে তারা গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কিন্তু এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সব শেষে গাড়ির চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে থামানোর চেষ্টা করে।
এ অবস্থায় গুলির আঘাতে গাড়ির বাঁ পাশের সামনের ও পেছনের দুটি চাকা পুরোপুরি পাংচার হয়ে গেলেও চালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ধানমন্ডির সুধা সদনে নিয়ে যান।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউজুড়ে লাশ আর রক্তের স্রোত : ওই দিনের ঘটনার ভিডিওচিত্রে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। তারপর ধোঁয়ার কু-লী। ভিডিওচিত্রে আরও দেখা যায়, আহতদের চিৎকার, কান্না-আহাজারির করুণ দৃশ্য।
আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও রমনা ভবনের সড়কে জায়গায় জায়গায় রক্তের স্রোত। ছেঁড়া স্যান্ডেল, ছোপ ছোপ রক্ত, পড়ে থাকা ব্যানার, পতাকার সঙ্গে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল নারী-পুরুষের দেহ ও শরীরের বিভিন্ন অংশ।
কেউ নিথর-স্তব্ধ, কেউবা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে আহত রক্তাক্ত নেতাকর্মীদের ছোটাছুটি করছেন। শেখ হাসিনাকে গাড়িতে ওঠানো হলে ট্রাক থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় নামতে থাকেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। যারা অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, তাদের ধরে নামানো হয়।
আহতদের মধ্যেও অনেককে ধরে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে নেওয়া হয়। এ অবস্থায়ই রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশা-ভ্যানেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আশপাশের হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এ সময় অনেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাতে থাকেন। যাদের মধ্যে বেশ কয়জন নারীরও ছিলেন। আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলের চারদিকে তখন যেন রক্তের স্রোত বইছিল। আহতদের বক্তব্য, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়ও ওই দিনের ভয়াল চিত্র ফুটে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়