বুধবার ১৫ মে ২০২৪ ||
জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১
|| ০৭ জ্বিলকদ ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ১১ জানুয়ারি ২০২২
নিয়োগ পরীক্ষায় প্রায়ই উঠেছে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ। এমন কাণ্ডে পরীক্ষা বাতিলেরও নজির রয়েছে। সরকারি দপ্তরগুলোতে কম্পিউটার অপারেটর ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে অযোগ্যদের নিয়োগের অভিযোগও কম নয়।
তবে বৃত্ত ভাঙার আওয়াজ দিল রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) অটোমেটেড ডিজিটাল টাইপিং সিস্টেম সফটওয়্যার ‘ই-জয়’। নিজস্ব সফটওয়্যারে এই দুই পদে নিয়োগ দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। রাকাবের উদ্ভাবিত ‘ই-জয়’ আশা দেখাচ্ছে আগামীর নিয়োগ পরীক্ষায়।
জানা গেছে, কম্পিউটার অপারেটর পদে সফটওয়্যার ‘ই-জয়’ এ বাছাই করে ৩২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ পেয়েছেন ১৪৬ জন। এই পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে গত ২৬ ডিসেম্বর।
রাকাবের কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, কম্পিউটার অপারেটর পদে এমসিকিউ পরীক্ষায় অংশ নেন ১ হাজার ৭৯২ জন চাকরিপ্রত্যাশী। উত্তীর্ণ ৫১৩ জন অংশ নেন ৩ ডিসেম্বর অটোমেটেড ডিজিটাল টাইপিং সিস্টেম সফটওয়্যারে ব্যবহারিক পরীক্ষায়। ব্যবহারিকে উত্তীর্ণ হন ৯৮ জন, যান মৌখিক পরীক্ষায়।
অন্যদিকে, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে মোট পদে এমসিকিউ পরীক্ষায় অংশ নেন ৩ হাজার ১৪ জন। উত্তীর্ণ ৭৭৭ জন ৪ ডিসেম্বর একই পদ্ধতিতে ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এই পদে ব্যবহারিকে উত্তীর্ণ হন ২৬৭।
এই দুটি পদেই সফটওয়্যারে পরীক্ষায় অংশ নেন চাকরিপ্রত্যাশী নাজনিন নাহার নিলা। তিনি জানান, সফটওয়্যারে পরীক্ষা নিয়ে আগে থেকেই তার মধ্যে ভীতি কাজ করছিল। কিন্তু কেন্দ্রে এসে তার ভীতি কেটে যায়। কেন্দ্রের প্রবেশের পর থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ পর্যন্ত রাকাবের আন্তরিকতা ছিল। এতে তার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে অনেকাংশে। এর ফলও পেয়েছেন পরীক্ষায়।
একই ভাষ্য আরেক চাকরিপ্রত্যাশী ঝন্টু আলীরও। তিনি জানান, আগেও একই পদে অনেক পরীক্ষায় তিনি অংশ নিয়েছেন। কিন্তু আগে কোথাও এমন পরীক্ষার পরিবেশ পাননি। পরীক্ষার পদ্ধতিটিও তার কাছে ভালো লেগেছে। অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব বলে মন্তব্য করেন এই চাকরিপ্রত্যাশী।
পরীক্ষা চলাকালে পুরো কার্যক্রম দেখভালে ছিলেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ম্যানেজার (ইন্টার্নশিপ) মাহবুব করিম। পরীক্ষার্থীদের মতো তিনিও এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণে সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, এই ধরনের পরীক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি সীমিত কিছু আছে। তবে রাকাবের তৈরি করা এই পদ্ধতিটি একেবারেই ইউনিক। এছাড়া আগের পদ্ধতিগুলোর চেয়ে এটি অনেক বেশি কার্যকর।
এটা লোকাল নেট ওয়ার্ক-ইন্ট্রানেটে সীমাবদ্ধ থাকছে। ফলে এটি হ্যাক হওয়ারও সুযোগ নেই। এতে স্বচ্ছতা পুরো মাত্রায় থাকছে। আমরা পরীক্ষার ফল সাথে সাথেই পেয়ে যাচ্ছি। সফটওয়্যারটি আসলেই অনুকরণীয়। পাইলটিং করে এই পদ্ধতিটি ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে এই বিশেষজ্ঞ।
সফটওয়্যারটির উদ্ভাবক এবং নির্মাতা রাকাবের উপ-মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম। তিনি জানান, এ বিভাগের এক ঝাঁক তরুণ ও মেধাবী আইটি কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের সহযোগিতায় দ্রুততার সাথে সফটওয়্যারটি ডেভেলপ করে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরোপুরি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ সম্পন্ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইলেট্রনিক্যালি এই চ্যালেঞ্চ জয় করেছে রাকাব। আর জনই সফটওয়্যারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ই-জয়’।
তিনি আরও বলেন, এই সফটওয়্যার তৈরিতে ‘রেস্ট্রিক্টেড টাইপিং মেথড’ প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এটি অধিক কার্যকরী। প্রথমেই প্রার্থীকে তার পরিচিতি নিশ্চিত করতে রোল নম্বর এবং জন্ম তারিখ দিয়ে ওয়েব-বেইজড সিস্টেমে লগইন করতে হবে। এরপর আসে প্রার্থীর স্বতন্ত্র ডায়নামিক ড্যাশবোর্ড। সেখানে প্রার্থীর নাম, ছবি ও স্বাক্ষরসহ যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য থাকে। এই তথ্য দেখে কক্ষ পরিদর্শক প্রার্থী যাচাই করেন।
উদ্ভাবক বলেন, পরীক্ষা শুরুর আগেই পরীক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে যাবতীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে সফটওয়্যারটিতে। মূল পরীক্ষায় যাওয়ার আগে এক মিনিটের অনুশীলন শেষ করতে হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষা শুরু এবং টাইমার চালুসহ নির্ধারিত সময় শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরীক্ষা শেষ হয়।
ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেম গাইডেড। সিস্টেমটি বাংলা এবং ইংরেজি উভয় টাইপিংয়ের ব্যবহারিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর। প্রার্থীর স্বতন্ত্র ডায়নামিক ড্যাশবোর্ড তাৎক্ষণিকভাবে হালনাগাদ দেখায়। এছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে সফটওয়্যারটিতে ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ ও প্রিন্টিং করা যায়। সফটওয়্যারটি সার্বিক ম্যানেজমেন্টের জন্য রয়েছে পাসওয়ার্ড প্রটেকটেড অ্যাডমিন প্যানেল।
এই উদ্যোগের শুরুর গল্প শুনিয়েছেন উদ্ভাবক। তিনি বলেন, ৬ নভেম্বর ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫টি ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত আরও তিন ব্যাংকের দুটি লিখিত পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।
ওই সময় রাকাবের এই দুটি পদে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছিল। নিয়োগে স্বচ্ছতার উপর জোর দেন ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিয়োগ কমিটির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। টাইপিং সফটওয়্যার তৈরি করে নিজস্ব কম্পিউটার ল্যাবে ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অটোমেটেড ডিজিটাল টাইপিং সিস্টেম সফটওয়্যার ডেভেলপ করেন।
চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার আগে দফায় দফায় এটির পরীক্ষা চলে। সর্বশেষ ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সফটওয়্যারটির কার্যকারিতা যাচাই করেন। ওই সময় ব্যাংকের নিয়োগ উপ-কমিটির সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হওয়ায় এতে ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এই পদ্ধতিতে স্বচ্ছতার সাথে দক্ষদের বেছে নেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাকাবের কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডিজিএম ও নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব রণজিৎ কুমার সেন। তিনি বলেন, মূল পরীক্ষা শুরুর আগে প্রার্থীদের ১০ মিনিট পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ব্রিফিং করা হয়েছে। অনুশীলনের সুযোগও পেয়েছেন প্রার্থীরা। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এতে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে সুবিধা হয়েছে। সবসময় দক্ষকর্মী জনশক্তি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এবিষয়ে রাকাবের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এমসিকিউ পরীক্ষার পর আমরা চিন্তা করলাম স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি নিয়ে। আমাদের সমৃদ্ধ ও দক্ষ কর্মকর্তা-সম্বলিত আইসিটি বিভাগ রয়েছে। তাদের সহায়তা নিয়ে আমরা নিজস্ব সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেছি। সয়ংক্রিয় এই পরীক্ষায় দ্রুত ফলাফলও পাওয়া গেছে। আমরা আশা করছি, আগামীতেও আমাদের যাবতীয় নিয়োগ পরীক্ষা এমন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিতে পারব।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়