রোববার ০২ জুন ২০২৪ ||
জ্যৈষ্ঠ ১৮ ১৪৩১
|| ২৫ জ্বিলকদ ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
প্রকাশিত: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
রাজশাহীর বাঘা উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটারের পথ হলো গড়গড়ি চর। এর মধ্যে দুই কিলোমিটার নদীর ওপরের অংশ। আর পদ্মার নদীর ভিতরে চরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া কাঁচা রস্তা এক কিলোমিটারের মতো। এই কাঁচা রাস্তার মাঝখানে বয়ে গেছে ছোট একটি সরু নদী। সুস্ক মৌসুমে এটি দিয়ে বয়ে যায় পদ্মার একটি অংশের পানি।
তবে ভরা বর্ষা মৌসুমে গোটা চরই ডুবে যায়। তখন নদীটিকে আলাদাভাবে চেনার উপায় নাই। এই নদীর দক্ষিণ পাশ থেকেই বিশালাকার এলাকা জুড়ে শুরু হয়েছে বরই (কুল) বাগান। প্রতিটি বাগান একেকটির সঙ্গে মিশে একাকার। কেবল বাগান মালিকই জানেন কোন সীমানা পর্যন্ত কার বাগান। এর বাইরে সহজে কোনো বাগানকে পৃথক করার উপায় নাই।
প্রতিটি বাগানের বরই গাছগুলোতে থোকায় থোকায় ধরে আছে সবুজ রংয়ের বরই। দেখে মনে হবে বরই নয় যেন থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙ্গুর ফল।
কৃষকদের দেওয়া তথ্য মতে এবং সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকদের উদ্ভাবিত গার্ডলিং (বরই গাছেই ডালের বিভিন্ন অংশে গোলাকার করে ছাল কেটে দেওয়া) বরই চাষ পদ্ধতিতে এখানে এসেছে ব্যাপক সাফল্য।
এ পদ্ধতির কারণে প্রতিটি গাছে বরই যেমন আকারে বড় হয়েছে, তেমনি খেতেও সুস্বাদু। ফলে অন্যনান্য এলাকার বরইয়ের চেয়ে বাঘার এই বাগানগুলোর বরইয়ের চাহিদাও বেড়েছে ব্যাপক হারে। এতে করে বাঘার এ বরই মাতাচ্ছে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনিসহ দেশের বিভিন্ন বাজার।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বরই বাগানগুলোতে বিপুল পরিমাণ বরই ধরে আছে। যেন পাতা আর বরই সমানে সমানে ঝুলছে গাছে। পাতার গাড়ো সবুজের চেয়ে হালকা সবুজ রংয়ের অধিকাংশ বরই। কেবল যেসব বরই বেশি পেকে গেছে, সেগুলোতে হলুদাভ রং চড়েছে। কোনো কোনোটি পেকে ফেটেও গেছে। আবার গাছের নিচেও পেকে পেকে পড়ে আছে প্রচুর পরিমাণে বরই। যেন মাটি আর গাছ মিলে বরই বরই হয়ে আছে। মাটিতে পড়া বরইগুলোও কুড়িয়ে কুড়িয়ে প্যাকেটজাত করছেন শ্রমিকরা। আবার গাছ থেকেও পাড়া হচ্ছে বরই।
কোনো বাগানে সেঁচ দিতে ব্যস্ত কৃষক। আবার কোনো বাগানের মধ্যে বরই পেড়ে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে বাঘার গড়গিড় নামের এই চরটি হয়ে উটেছে বরইময়।
বাঘা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, এই চরে এবার প্রায় দুই হাজার বিঘা জমিতে বরই আবাদ হয়েছে। এ পরিমাণ জমিতে গত কয়েক বছর ধরেই বরই আবাদ হচ্ছে। শুরুটা হয় ২০০৮ সাল থেকে। বরই চাষে একেবারে সফল চাষি সানাউল্লাহ প্রথম বালুময় এ চরে বরই চাষ শুরু করেন। তার দেখা দেখি পরের বছর থেকেই ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করে। একে একে গড়ে ওঠা বরই বাগানগুলোর কারণে এখন আর কোথাও বালুর অস্তিতও তেমন চোখে পড়ে না।
সব জমিতেই মাটিতে পরিণত হয়েছে বালুগুলো। বর্ষায় ডুবে যায় এই বাগানগুলো। তখন পলিমাটি এসে জমাট বাধে। ফলে প্রচুর উর্বর এই জমিতে অন্যান্য মাটির চেয়ে বরই চাষে খরচ অনেকটা কম হয়। তার পরেও যে পরিমাণ সার প্রয়োজন হয়, সেটিও প্রয়োজনমতো পান না বলে অভিযোগ করেছেন কৃষক নাহিদ হাসান।
নাহিদ হাসান জানান, তিনি ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। কিন্তু বরই বাগান তিনি ছাড়েননি। সেই অস্টম শ্রেণিতে পড়া-লেখা করা অবস্থায় চার বন্ধু মিলে প্রথমে এই চরের চার বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে বরই চাষ শুরু করেছিলেন। এখন তাঁর নিজস্ব ১২ বিঘাসহ মোট ১৫ বিঘা জমিতে রয়েছে বরই বাগান।
এভাবে তাঁর মতো প্রতিটি বাগান মালিকের সর্বনিম্ন অন্তত ৫ বিঘা জমিতে বরই বাগান রয়েছে। প্রতিটি বাগান থেকে এবার দাম কম থাকলেও বিঘা প্রতি অন্তত লাখ টাকার বরই বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি। আর বছর জুড়ে একেক বিঘা জমিতে খরচ হচ্ছে ৪০-৪৫ হাজার টাকা করে। ফলে নিজস্ব জমি হলে সব খরচ বাদ দিয়েও অন্তত ৪০ হাজার টাকা পকেটে থাকবে বলেও আশা করছেন নাহিদ হাসান।
তিনি বলেন, ‘বরই বাগানে প্রচুর শক্তি দিতে হয়। আমাদের চরের জমি হওয়ার কারণে জমি উর্বর হওয়ার পরেও যে বছরে অন্তত চার-৫ বার ফসফেট ও ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু বাজারে এ দুটি সারেরই সঙ্কট। ফলে বাড়তি দামে সার কিনতে হয়। আবার প্রয়োজনের তুলনায় পাওয়ায় যায় না। ফলে সারের অভাবে বরইয়ের আকার ছোট হয়। প্রয়োজনমতো সার দিতে পারলে আকার বড় হয়। তখন কেজি ২০টা বরই ধরে। তবে আকার ছোট হলে কেজিতে ৩০-৩৫টা বরই ধরে।’
আরেক কৃষক শামসুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বরই বাগানগুলোর বয়স অন্তত সাত বছরের কম নয়। কিন্তু তার পরেও প্রতি বছরই আমরা সমান তালে বরই পাচ্ছি। এর অন্যতম কারণ হলো, এখানকার প্রতিটি বাগানই গার্ডলিং পদ্ধতিতে বরই চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিটি কৃষকরাই আবিস্কার করেছেন। প্রতিটি গাছে তিন-চার জায়গায় গলাকার করে চামড়া বা ছাল কেটে দেওয়া হয়। এতে করে গাছের পাতা যে শক্তি ধারণ করে, সেটি নিচের দিকে নামতে পারে না।
ফলে পাতার পরিমাণ মেন বেশি হয়, তেমনি বরইয়ের পরিমাণও বেশি হয়। গাছ সাধারণ শক্তি পাতা থেকে ছাল দিয়ে শেকড়ে নিয়ে যায়। ছাল গোরাকার করে কাটার ফলে সেকড়ে যেতে পারে না। ফলে শক্তিও নষ্ট হয় না। যার ফলে গার্ডলিং পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে বাঘার এ বাগানগুলো থেকে প্রতিটি গাছ থেকেই অন্তত ৬-৭ মণ হারে বরই সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে প্রতি বছর।’
আরেক কৃষক কৃষক আবু বলেন, ‘বরই বাগানের কারণে শুধু আামদের যে লাভ হচ্ছে তা নয়, স্থানীয় বেকার যুবকদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় এই তিন মাসে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে যখন বরই পাড়া শুরু হয়, তখন থেকেই প্রতিটি বাগানে অন্তত ৫ জন করে শ্রমিক লাগে বরই পাড়া থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত করা পর্যন্ত কাজে। যে পরিমাণ শ্রমিক প্রয়োজন হয়, সে পরিমাণ শ্রমিক আমরা পাই না। একেকজন শ্রমিককে প্রতিদিন ৩৮০ টাকা করে দেওয়া হয়। ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরী হয়েছে এই বাগানগুলোর কারণে।’
বিচ্ছেদ নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘আমার ১৫ বিঘা জমিতে বরই বাগান আছে। সাথে আমগাছও রয়েছে। বরই থেকেই এ বছর অন্তত ১০ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করছি। এর পরে আমগাছ থেকে বিভা প্রতি কিছু না হলেও ২০-২৫ হাজার টাকার আম আসবে। সেই টাকা দিয়ে জমি বন্ধকেও টাকাও উঠে আসবে। একটু সময় ও পরিশ্রম দিলে বাঘার চর থেকে বরই চাষ করে কেউ খালি হাতে ফিরে না। বছর শেষে মোটা অংকের লাভ নিয়েই সবাই বাসায় ফিরি। ফলে অনেকেই একেবারে দিনমজুর থেকে এখন গাড়ি-বাড়িরও মালিক হয়েছি শুধু বরই চাষ করে।’
মনিরুল ইসলাম সেলিম নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘বাঘা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের কর্মকর্তারা আন্তরিক। নানা প্রয়োজেন আমরা তাদের পাশে পাই। কিন্তু বরাদ্দ কম থাকায় আমার বরই বাগানে সার ঠিকমতো দিতে পারি না। আমাদের দাবি কৃষি নির্ভর বাগায় সারের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হোক। তাহলে বরই চাষে আরও বিপ্লব ঘটবে।’
নজরুল ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, আমাদের সব বরই চলে যায় দেশের বিভিন্ন আড়তে। বর্তমানে বাজার অনুযায়ী প্রতি মণ বরই বিক্রি হচ্ছে ১০০০-১২শ টাকা মণ দরে। গতবারের চেয়ে এবার কেজিতে ২০-২৫ টাকা কম দরে বরই বিক্রি হচ্ছে। তবে শেষ দিকে গিয়ে দাম বাড়বে আশা করি। সব মিলিয়ে এ বছরও ভালো টাকা লাভ হবে বলে আশা করছি।’
বাঘা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ সুলতান জনি বলেন, ‘বাঘার গড়ি গড়ি চরেই অন্তত ২৬০ হেক্টর (প্রায় ২ হাজার বিঘা) জমিতে বরই চাষ হচ্ছে। যেখান থেকে প্রতি হেক্টরে ৪৫ মেট্রিক টন বরই উৎপাদন হচ্ছে। সেই হিসেবে বছরে গড়ে এই চরে ১২ হাজার মেট্রিক টন বরই উৎপাদন হচ্ছে।
এ চরে বরই চাষে কৃষকদের সাফল্যও এসেছে ব্যাপক হারে। ফলে একেকটি বাগান ৭-১৪ বছর ধরে রয়েছে। তবে গত দুই তিন বছর ধরে কৃষকরা সার সঙ্কটে ভূগছেন বরাদ্দ কম থাকায়। এটি নিরসনেও আমরা করা করছি। বরাদ্দ জেলা থেকে বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।’
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়