শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১৩ ১৪৩১
|| ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
বুলবুল হাবিব
প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯
ছয় কাঠা দোতালা বাড়ির ছাদে বিশাল বড় শেড। শেডটি নীল জাল দিয়ে ঘিরে রাখা। শেডের ভেতরেই নানা আকৃতির প্লাস্টিক টবে রাখা নানা জাতের ক্যাকটাস। চারাগাছ থেকে বড় আকৃতির। টবগুলো দেখতেও ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির। আকৃতি অনুযায়ী এসব টবের কোনোটিতে চারাগাছ বপণ করা হয়েছে, কোনটিতে গ্রাফটিং করা হয়েছে আবার কোনটিতে গ্রাফটিং করার পর তুলে একটু বড় হওয়ার পর লাগানো হয়েছে।
প্রায় দেড় হাজার সারি সারি টব রয়েছে শেডটির ভেতরে। গাছ রয়েছে ৪ হাজারের মতো। চারাগাছগুলো এক একটি টবে ৫০ টির মতো রাখা গেলেও বড় গাছগুলো একটি টবে একটিই রাখতে হয়।
তবে শেডের ভেতরে সবচেয়ে যেটা বড় পরিসরে করা হয়, সেটা হচ্ছে বীজের অঙ্কুরোদগমন। প্রায় ১২ হাজার বীজের অঙ্কুরোদগম করা হচ্ছে এই শেডটিতে। এজন্য রয়েছে প্রায় শ’ খানেক প্লাস্টিকের বক্স। এক একটি বক্সে অঙ্কুরোদগমনের জন্য ফেলা হয়েছে ২০০ থেকে এক হাজার বীজ। অবশ্যই এজন্য বিশেষ প্রকিয়ায় মাটি প্রস্তুত করে প্লাস্টিক বক্স ভর্তি করতে হয়। টবের জন্যও বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটি প্রস্তুত করতে হয়।
অর্থাৎ এই শেডের ভেতরে বীজ থেকে চারাগাছ, চারাগাছ থেকে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে ক্যাকটাস বড় করা পর্যন্ত সবই করা হয়। তারপর পর্যাপ্ত বড় করে ক্যাকটাস বিক্রি করা হয়।
শুধু দোতালার এই ছাদেই নয়, একতলার ছাদের বর্ধিত অংশেও ইট বালু ও সিমেন্ট দিয়ে টানা শেড তৈরি করা হয়েছে। সেখানেও ক্যাকটাসের বীজ থেকে চারাগাছ ও বড় ক্যাকটাস উৎপাদন করা হয়।
আর এসব সবই করেন মাসুক আলম খান নামের একজন যুবক। রাজশাহী মহানগরীর কুমারপাড়া মোড়েই বড় রাস্তার ধারেই তার বাড়ি। তার বাবার নাম আবুল হাসান খান। বড় রাস্তা ধরে সাহেব বাজারের দিকে গেলে কিংবা সাহেব বাজার থেকে তালাইমারীর দিকে এলে যে কারো সহজেই চোখে পড়বে বাড়ির ছাদের বিশাল বড় শেড। কৌতূহলী নাগরিকরা হয়তোবা বুঝতেই পারবেন না এই শেডে কী হচ্ছে!
মাসুক আলম খান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স কালেকশন বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। অফিসের সময়ের বাইরে তার অধিকাংশ সময় কাটে এই ক্যাকটাস গাছের পরিচর্যা, পরিকল্পনা, বিপণন ও বাজারজাত করে। বাণিজ্যিকভাবে ক্যাকটাস উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ করছেন তিনি।
মাসুক আলম বলেন, ‘তিনটি পর্যায়ে এই শেডে ক্যাকটাস চাষাবাদ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ছোট ছোট প্লাস্টিকের বক্সে বীজের অঙ্কুরোদগমন ঘটানো হয়। একটি বক্সে ১০০টি বীজের অঙ্কুরোদগমন ঘটনা হলে সেখান থেকে কমপক্ষে ৫০টি চারাগাছ পাওয়া যায়। এরপর সেসব চারাগাছগুলোর অর্ধেক টবে পুনঃবপন করা হয় আর অর্ধেক গ্রাফটিং করেন। তৃতীয় ধাপে, গ্রাফটিং করার পর গাছ বড় হলে তুলে আলাদাভাবে আরেকটু বড় টবে লাগানো হয়। একটু ক্যাকটাস গাছ পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধি পেতে তিন বছর সময় নেয়। কিন্তু গ্রাফটিং করা হলে দেড় বছরে তা পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধি পায়’।
মাসুক আলমের দাবি, ‘ক্যাকটাস বাংলাদেশের অনেকেই চাষাবাদ করলেও বীজের অঙ্কুরোদগমন করে চারাগাছ তৈরি করে এত বড় পরিসরে তিনিই একমাত্র করছেন। বীজগুলো তিনি ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে নিয়ে আসেন। তার কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেকেই চারাগাছ ক্রয় করে বিক্রি করছেন’।
মাটি প্রস্তুত:
ক্যাকাটাস চাষাবাদ করার জন্য বিশেষভাবে মাটি প্রস্তুত করতে হয়। বীজের অঙ্কুরোদগমনের জন্য একভাবে ও চারাগাছের জন্য আলাদাভাবে মাটি প্রস্তুত করতে হয়। এইজন্য বালি, পাথর কুচি দানা, গোবরের সার, পচা পাতা, হাড়ের গুড়া ও কয়লা দিয়ে মাটি প্রস্তুত করতে হয়।
মাসুক আলম বলেন, ‘বীজের অঙ্কুরোদগমনের জন্য মাটি প্রস্তুত করা সবচেয়ে কঠিন। এইজন্য বেশ শ্রম দিতে হয়। আবার কাজগুলো এমন সূক্ষ্ণ যে শ্রমিক দিয়েও করানো যায় না। নিজেকেই করতে হয়। তবে মাটি প্রস্তুত হয়ে গেলে খুব বেশি পানি না দিলেও চলে। সপ্তাহে একবার পানি দিলেই চলে। বরং পানি বেশি দিলে ক্যাকটাসের শিকড় পচে যাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এইজন্য পর্যাপ্ত রোদ যাতে পায় এমন জায়গায় ক্যাকটাস চাষাবাদ করতে হয়’।
দরদাম:
কটাসের বীজগুলো ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা হয়। মসুরের ডালের চেয়েও ছোট প্রতি পিস ক্যাকটাসের বীজের দাম ২০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্যাকটাসের এক পিস বীজের দাম তারচেয়েও বেশি। পুরো পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজার ক্যাকটাসের জাত থাকলেও মাসুক আলমের কাছে দেড়শো থেকে দুইশো জাতের ক্যাকটাস রয়েছে। তবে তারা সাধারণত কম দামের ক্যাকটাসগুলোই বাজারজাত করছেন। তারা বীজ থেকে চারা উৎপাদনের পর স্বল্পমূল্যে ৫০ থেকে ২০০ টাকায় চারাগাছ বিক্রি করছেন। আর ক্যাকটাসের গাছ বিক্রি করেন ১০০ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। তার কাছে বিক্রির উপযোগী ৪ হাজার গাছ রয়েছে।
মাসুক আলম মনে করেন, কেউ ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে ছয় মাসে তা ৭ লাখ টাকায় বিক্রির উপযোগী হবে।
অবকাঠামোগত খরচ ও শ্রম বাদ দিলে শুধু বীজের জন্যই তিনি গত একবছরে দুই লাখ টাকা খরচ করেছেন। প্রথম দফায় ৬০ হাজার টাকার বীজ ক্রয় করে তার মধ্যে থেকে কিছু গাছ বড় করে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। ওই টাকা দিয়ে আবার বীজ ক্রয় করেছেন।
মাসুক আলম বলেন, ‘আপাতত তিন বছর ক্যাকটাস বিক্রি করে যা আয় করব তার সবই ক্যাকটাস চাষাবাদে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে’।
ক্যাকটাস হাট:
রজশাহীতে গত বছর নভেম্বর মাসে মহানগরীর কাজীহাটায় এক ক্যাকটাসপ্রেমীর বাড়িতে বসেছিল ক্যাকটাসের হাট। রাজশাহীর ৮ থেকে ১০ জনের মতো ক্যাকটাস উৎপাদনকারী এবং ক্রেতারা সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হাটে উৎপাদনকারীরা তাদের ক্যাকটাস গাছগুলো নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া গত বছর সাহেব বাজারে সাত জন ক্রেতার উপস্থিতিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গাছগুলো বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া এবছরের নভেম্বর মাসে ক্যাকটাসপ্রেমীদের উপস্থিতি ঢাকা একটি গেট টুগেদার করেছেন ক্যাকটাসপ্রেমীরা। এছাড়া ক্যাকটাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শত শত ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে বিশ্বব্যাপি। যেখানে ক্যাকটাসপ্রেমীরা তাদের কাছে থাকা ক্যাকটাসের বিভিন্ন জাতের ছবি ব্যবহার করেন।
মাসুক আলম বলেন, আমি নিজে ৯৭৫ টি গ্রুপের সদস্য। এছাড়া আমার নিজের ‘বাংলাদেশ ক্যাকটাস সাকুলেন্ট লাভারস' নামের একটি গ্রুপ আছে। যেখানে ৮২ টি দেশের সদস্য রয়েছে। গ্রুপের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার।
শুরুর কথা:
ব ছোটবেলা থেকেই গাছ অন্তঃপ্রাণ ছিলেন মাসুক আলম খান। ১৯৯৭ সালে তিনি ভারতের কালিম্পং ও ভুবনেশ্বর ঘুরতে যান। সেখানকার বিখ্যাত বিখ্যাত ক্যাকটাস শেড ঘুরে দেখেন। তখনই তার মাথায় ভূত চাপে এরকম একটি ক্যাকটাস শেড নিজের মতো করে তৈরি করবেন বাংলাদেশে। যেখানে ক্যাকটাসের বিভিন্ন জাতের ক্যাকটাস উৎপাদন করবেন। বড় পরিসরে করবেন বীজের অঙ্কুরোদগমন। তখন থেকেই ভারত থেকে কিছু কিছু গাছ নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে শুরু করেন। তবে মাঝখানে কয়েকবছর বন্ধ ছিলো তার এ কার্যক্রম। গতবছর থেকে আবার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেন তিনি। আর এ কাজে সহায়তা করেছেন থাইল্যান্ড ফেরত মেসবাহ উদ্দিন। মেসবাহর বাড়ি নগরীর সাধুর মোড় মহল্লায়। তখন দুইজনে মিলে নতুনভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। মূল পরিকল্পনা ও কার্যক্রম মাসুকের হলেও মেসবাহ থাইল্যান্ড থেকে বীজ আনা নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেন। তার সাধুর মোড়ের বাড়িতেও তৈরি হচ্ছে আরেকটি শেড। রয়েছে ডিসপ্লে সেন্টার।
মেসবাহ বলেন, ‘ ৯৭ সালে মাসুক ভাইয়ের সাথে কাজ শুরু করলেও কয়েকবছরের জন্য থাইল্যান্ডে চলে গিয়েছিলাম। থাইল্যান্ড থেকে ফিরে আবার নতুন উদ্যমে মাসুক ভাইয়ের সাথে নতুন উদ্যম নিয়ে শুরু করেছি।
মাসুককে পরিবারের লাোকজন সবাই পাগল বলে মনে করেন মাসুককে। তার স্ত্রী রাফিকা রুখসানা লাবণীও তার স্বামীকে পাগল মনে করেন। তবে কাজে সহায়তাও করেন।
তিনি বলেন, অফিসের বাইরে পুরো সময়টুকু গাছ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দিনরাত শুধু গাছ আর গাছ। যখন গ্রাফটিং করে তখন গভীর রাতও হয়ে যায়। আবার মাটি তৈরি করাটাও কঠিন কাজ। সেখানেও সহায়তা করতে হয়’।
মাসুক ও লাবণী দম্পতির একমাত্র সন্তান রিদওয়ান হোসেন খান। ছয় বছরের রিদওয়ানও গাছ অন্তঃপ্রাণ। সারাক্ষণ বাবার সাথে এই শেডে কাটায়। শিখে ফেলেছে গ্রাফটিংও। আর অনর্গল বলতে পারে ক্যাকটাসের বিভিন্ন জাতের কঠিন কঠিন ইংরেজি নাম। গত মঙ্গলবার রিদওয়ান এই প্রতিবেদককে দেখিয়ে বলে, এই গাছের নাম অ্যাস্টোফাইটাম ম্যারিও স্টিগমা, এই গাছের নাম অ্যাস্টোফাইটাম অ্যাস্টারিস, এই গাছের লাভিবিয়া.....’
কারা ক্রয় করেন:
মাসুক আলম বলছিলেন, যারা গাছ ভালোবাসেন, যারা গাছ অন্তঃপ্রাণ, যারা সৌন্দর্য প্রিয়, তারা সবাই গাছ ক্রয় করতে পারবেন। তবে গাছগুলো বাড়ির পর্যাপ্ত আলোকিত স্থানে, সেটা হোক বাড়ির বারান্দা কিংবা ছাদে রাখতে হবে।
তবে শিক্ষিতদের মধ্যে গাছ ক্রয়ের চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্যাকটাস ল্যান্ডস্কেইপ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র ক্যাকটাস ল্যান্ডস্কেইপ রাজশাহীর র্যাব-৫ অফিসে করেছেন মাসুক।
মাসুক বলেন, মাটি ঠিকমত প্রস্তুত করা গেলে ক্যাকটাস গাছে একমাস পানি না দিলেও মরে না। বরং গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে ক্যাকটাস গাছ মরে যায়।
স/এমএস
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়