শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১৩ ১৪৩১
|| ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
আবুল কালাম আজাদ সনি, চারঘাট
প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০২০
বেদনাবিধুর ১৩ই এপ্রিল, চারঘাট গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে এই দিনে সকালে অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে চারঘাট উপজেলার থানাপাড়া গ্রামসহ কুঠিপাড়া, গৌরশহরপুর, বাবুপাড়ার প্রায় ২ শত মানুষকে অপারেশন সার্চ লাইট নামে নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষদের গুলি করে হত্যা করে। নামে ও বেনামে আরও প্রায় ২ শত মানুষ আহত হন। রাজশাহী জেলার ২৭ কি:মি: দক্ষিনে পদ্মা-বড়াল বহমান চারঘাট উপজেলা।
চারঘাট উপজেলারই একটি মণোমুদ্ধকর গ্রাম থানাপাড়ায় ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল মঙ্গলবার বেলা ১২টায় যা ঘটেছিল সেই ঘটনা আজও মনে পড়লে বুক থরবর করে কেঁপে উঠে। মনে পড়ে বুক ফাড়া আর্তনাদ, চিৎকার-বাঁচাও, বাচাঁও, আবার কখন একটু পানি বলেন হত্যাযজ্ঞ ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ওয়ার্ড কমিশনার আজমল হোসেন মতি। ইতিহাসের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই অগ্নিঝরা ভাষন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে একদল যুবক মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধিনতা এনে দেওয়ার শপথ নেন।
তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ শিবলী, আকরাম আলী, মোকাররম হোসেন হেজু, মোজাফ্ফর হোসনে বাদল, নুরুল হক, হুমায়ুন কবীর, তবিবার রহমান। চারঘাট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ছিল চারঘাট উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ক্যাম্প। বেলা ১০ টার পর খবর এলো পাক বাহিনী নাটোর থেকে রাজশাহীর দিকে আসছে। জানা যায়নি তারা পুলিশ একাডেমী সারদাতে আসবে। দুদিন আগে সারদা পুলিশ একাডেমীর যত অস্ত্র ছিল সবগুলো ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী থানাপাড়া সোয়ালোজের নির্বাহী পরিচালক রায়হান আলী জানান, ১৩ ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল আমার বয়স ১৩। আনুমানিক প্রায় ১০ ঘটিকার সময় অস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনী সায়রন বাজিয়ে সারদায় অবস্থিত তৎকালীন পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার লুট করা অস্ত্র উদ্ধার করতে আসে। সারদা আসতে গিয়ে পাক বাহিনী মোক্তারপুর ট্রাফিক মোড় ও সারদা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাধাগ্রস্ত হয়ে আধাঘন্টা গুলিবিনিময় হয়।
শহীদ হন ইউসুফ, দিদারসহ বেশ কয়েকজন। পাক বাহিনী পুলিশ একাডেমীর ভিতর ঢুকে পদ্মা নদীর চরে কয়েক হাজার নারী পুরুষ ও শিশু দেখতে পায়। সকলেই ভীত সম্ভ্রব নিরস্ত্র সাধারন মানুষ, আত্মরক্ষার্থে গ্রাম ছেড়ে সীমান্তবর্তী পদ্মা নদীর তীরে অবস্থান নেন। আমি, আমার বাবা ও বড়ভাইয়ের সাথে নিজের জীবন রক্ষার্থে পদ্মা নদীর ধারে অবস্থান করি। কিছুক্ষণ পরে পাক হানাদার বাহিনী পদ্মার চারপাশে আমাদের ঘেরাও করে। নারী ও শিশুদের একদলে ভাগ করে এবং সকল পুরুষদের আরেকটি দলে ভাগ করে। পুরুষদের অপেক্ষা করতে বলে নারী ও শিশুদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। শুরু হয় ব্রাশফায়ার, সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ, আকাশে কুন্ডুলি পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া।
শুধু গুলি করেও ক্ষান্ত হননি হানাদার পাকবাহিনী, মৃত্যু নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা। চারঘাটকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করার সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী জেনোসাইড শুরু করেন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা খুরশীদ আলম শিবলী এই থানাপাড়ার একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। যাকে পাক বাহিনী ধরে পাকিস্থান জিন্দাবাদ বলার জন্য বেয়নেট চার্জ করে। এমনকি তার শরীরের চামড়া ছিলে লবণ দিয়ে পাকিস্থান জিন্দাবাদ বলানোর চেষ্টা করা হয়।
শত নির্যাতন করা সত্বেও পাক হায়েনারা শিবলীর মুখ থেকে জয় বাংলা ছাড়া কোন শব্দ বের করতে পারেনি। অত:পর শিবলীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শিবলী যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তার নির্মম ও রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা শুনতে ও সমবেদনা জানাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ থানাপাড়ায় তার বাড়িতে ভিড় জমায়। ১৩ই এপ্রিল প্রতি বছর থানাপাড়াবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় ৭১’ সালের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা।
আজও ছেলেহারা, স্বামীহারা আত্মীয়স্বজন হারানোর ব্যাথায় তারা দিশেহারা হয়ে ফ্যাল ফ্যাল হয়ে চেয়ে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপির আন্তরিক চেষ্টায় সরকারীভাবে ১৩ই এপ্রিল ঘটে যাওয়া গনহত্যাকে চারঘাট গনহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং গনহত্যার স্মৃতি স্বরুপ ২০১১ সালে স্থাানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যেগে চারঘাট পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে তৈরি হয়েছে ১৭৪ জন শহীদের নাম সম্ভলিত স্মৃতিস্তম্ব।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারীভাবে এই গনহত্যা দিবসটি স্বীকৃতি লাভ করলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কোন ধরনের আর্থিক সহযোগীতা পাচ্ছে না। নামমাত্র কিছু বরাদ্দ থাকলেও সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পাচ্ছে না বলে জানান।
স/র
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়