শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪ ||
বৈশাখ ২০ ১৪৩১
|| ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২৩
সরকারি চাকরির কোনো ইচ্ছা নেই! ফলাফল ‘অল ফার্স্ট ক্লাস’, তবু দেননি বিসিএস পরীক্ষা। ড্রাগন চাষের আগ্রহ নিয়ে পরামর্শ নিতে ছুটে যান কৃষি কর্মকর্তার কাছে। কিন্তু ফিরতে হয় হতাশ হয়ে। তবু নিজের ইচ্ছায় ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন ড্রাগন চাষ। এরপরই করেছেন বাজিমাত। ঈর্ষণীয় সাফল্যের পর উল্টো কৃষি কর্মকর্তাকেই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গল্পটা আসির উদ্দিন নামে এক যুবকের। তার বাসা রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাটুপাড়া গ্রামে। বৃদ্ধ বাবা ওমর মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়েই চাষ করছেন ড্রাগন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থার রাজশাহী অঞ্চলের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তার ফলের বাগান দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন আশপাশের এলাকার উৎসুক জনতা।
আসির উদ্দিন শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত দেশসেরা কলেজ থেকে। তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে ভূগোলে অনার্স ও মাষ্টার্স সম্পন্ন করেছেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবার মাষ্টার্স করেন। ফলাফল—অল ফার্স্ট ক্লাস। তবে চাকরির বদ্ধ জীবন পছন্দ নয় আসির উদ্দিনের। সরকারি চাকরিতে তো একেবারেই আগ্রহী নন তিনি। যে কারণে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক প্রথম শ্রেণীর চাকরির পরীক্ষা ‘বিসিএস’-এর জন্য আবেদনই করেননি আসির। ঝুঁকি নিয়ে টাকা ধার করে ড্রাগন চাষ শুরু করা আসির উদ্দিনের বাগানে কাজ করে এখন সংসার চলছে ডজন খানেক পরিবারের।
অন্যের অধীনে কাজ করা আমার পছন্দ না। সেজন্য উদ্যোক্তা হয়ে কিছু করার আশায় ড্রাগনের চাষ শুরু করি। একইসঙ্গে আমগাছ ও লেবুগাছ লাগাই ওই জমিতে। আমার জমিতে কাজ করে আরও কয়েকটি সংসারেও সুদিন ফিরেছে। আমি শুরু করার পর একজন কলেজ শিক্ষককেও ড্রাগন চাষে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। তিনিও কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি ড্রাগন চাষ শুরু করেছেন।
আসির উদ্দিন
জানা গেছে, বছর চারেক আগে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের মোহনপুরের মৌগাছি বাজার সংলগ্ন সোয়া বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষের পরিকল্পনা করেন আসির উদ্দিন। রাজশাহী অঞ্চলের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করা নিজের বেসরকারী সংস্থা থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণ পান। এছাড়া বোনের কাছে ধার করেন দুই লাখ টাকা। সর্বমোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিক ড্রাগন চাষে নেমে পড়েন আসির। প্রায় ৩০ বছর মেয়াদী এ ফল চাষের পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ‘চাকরিবিমুখ’ এ যুবক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ড্রাগন ফলের জমিটির চতুর্পাশ ইটের দালান দিয়ে ঘেরা। পাশেই রয়েছে পানবরজ। ইটের দালানের বাইরে বাঁশ দিয়ে উঁচু মাচান তৈরি রয়েছে। সেখানে একজন ব্যক্তি পাহারাদারের ভূমিকায় মাচানের ওপর বসে রয়েছেন। ষাটোর্ধ ওই বৃদ্ধ আসির উদ্দিনের বাবা ওমর মণ্ডল।
এসময় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, পাহারা না দিলে চুরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য সার্বক্ষণিক একজনকে থাকতে হয়। একজনকে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে পাহারাদার হিসেবে। মাঝেমধ্যে তিনিও দেখভাল করেন।
ওমর মণ্ডল বলেন, আমার ব্যাটা (ছেলে) ম্যালাদূর (অনেক) পইর্যাস (পড়ালেখা করেছে), টাইটেল-বিএ সব কমপিলিট হয়্যাস (হয়েছে)। কিন্তুক ও চাকরি কইরবে (করবে) না। চাকরিত নাকি ছুটি কম, তাইকেনে (সেজন্য) এগ্ল্যান (এসব) কইরতে (করতে) লাগ্যাছলো (লেগেছিল)। ম্যালা (অনেক) ট্যাকা (টাকা) ধার-টারও তো লিয়্যাস (নিয়েছে)। কিন্তু বাপু, আল্লাহ দিলে ভালই লাভ হইসে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আসির উদ্দিন ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী। স্কুলজীবন থেকেই অনেক মেধাবী তিনি। অন্যের কাজ করে, প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই জোগাতেন। তবে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না করে এমন উদ্যোগের ফলে আরও কয়েকটি পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে ওই ড্রাগন বাগানে।
এ ব্যাপারে আসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে এমন উদ্যোগের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদী এ ফলের সন্ধান পাই নাটোরের একটি হর্টিকালচারে গিয়ে। আম গাছ কিনতে গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তা ড্রাগনের বিষয়ে আমাকে অবগত করেন। ঝুঁকি মনে হলেও কিনে এনে আমাদের সোয়া বিঘা জমিতে শুরু করি ড্রাগন চাষ। পরামর্শ নিতে আমাদের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাছে গিয়ে সেরকম কোনো সাপোর্ট পাইনি।
আসির উদ্দিন বলেন, অন্যের অধীনে কাজ করা আমার পছন্দ না। সেজন্য উদ্যোক্তা হয়ে কিছু করার আশায় ড্রাগনের চাষ শুরু করি। একইসঙ্গে আমগাছ ও লেবুগাছ লাগাই ওই জমিতে। আমার জমিতে কাজ করে আরও কয়েকটি সংসারেও সুদিন ফিরেছে। আমি শুরু করার পর একজন কলেজ শিক্ষককেও ড্রাগন চাষে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। তিনিও কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি ড্রাগন চাষ শুরু করেছেন।
ফলন ও লাভ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আসির উদ্দিন বলেন, বড় চালানে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি হয়। আর ছোট চালানে ২৫-৩০ হাজার টাকা পাই। প্রতি চালান অ্যাভারেজে প্রায় ৬০-৬৫ হাজার টাকা আসে। ২৫ ক্যারেটে প্রায় ১২-১৪ মণ করে ড্রাগন উঠে প্রতি চালানে। ৩-৪টি ড্রাগন ফলে এককেজি ওজন হয়। প্রতিকেজির দাম ২৭৫ টাকা। তবে খুচরা ৩২০-৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ড্রাগন। বর্তমানে প্রতিমণ ড্রাগন পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১১ হাজার টাকায়।
আসির উদ্দিন বলেন, চলতি বছর এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার ড্রাগন বিক্রি করেছি। অন্যান্য বছর প্রায় ১০ লাখ টাকার ড্রাগন উঠে। এবছর ১৬ চালান ড্রাগন তুলেছি। তবে আরও এক চালান উঠবে। ওটা সামনে সপ্তাহে তুলতে পারবো বলে আশা করছি। ড্রাগন ফলের বাইরেও দুই লাখ টাকার চারা বিক্রি করা হয়েছে। এ বছর আরও ৩ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ শুরু করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন আসির উদ্দিন।
এদিকে, আসির উদ্দিনের মতো জেলায় আরও অনেকে ড্রাগন চাষে ঝুঁকছেন। জেলাজুড়ে বেড়েছে ড্রাগন চাষ। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীতে মোট ৪৩টি ফল চাষের উপযোগী পরিবেশ থাকলেও বর্তমানে চাষ হচ্ছে ৪০ রকমের ফল। সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় উত্তরের এ জেলায়। তবে জেলায় আনারস, বিলাতিগাব ও কাজুবাদাম এখনো উৎপাদন হয়নি। চাষ হওয়া ফলের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ড্রাগন। অবশ্য স্টবেরি ফল চাষ হচ্ছে স্বল্প পরিসরে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজশাহীতে ড্রাগন চাষের তথ্য হালানগাদ করা হচ্ছে। সব উপজেলার রিপোর্ট এখনো জেলা কার্যালয়ে আসেনি। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ড্রাগন চাষ হয় ২১৪ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলায় সর্বোচ্চ ১৯০ হেক্টর জমিতে এ ফল চাষ হয়। এ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৪১৮ মেট্রিক টন ড্রাগন। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৭ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হয়। ওই অর্থবছরে ৬৮৮ মেট্রিক টন ড্রাগন উৎপাদন হয়। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ২৭ হেক্টর জমিতে চাষ হওয়া ড্রাগন উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩২৪ মেট্রিক টন। অর্থাৎ রাজশাহী জেলায় প্রতিবছর ড্রাগন চাষে আগ্রহ বাড়ছে মানুষের।
এ ব্যাপারে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, ড্রাগন অনেক নিরাপদ ফল। এখানে বিষ তেমন লাগেই না। এর খোসাও অনেক মোটা। আর হলো তেমন পোকা-টোকাও নাই। সবমিলিয়ে এটা লাভজনক এবং সারাবিশ্বেই এর চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশেও অনেক কাস্টমার বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমরা চাষিদের টেকনোলজিতে হেল্প করছি। যেকোনো পরামর্শ দেওয়া হয় তাদের। লাভজনক হওয়ায় ড্রাগনের আবাদও বাড়ছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়