শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১৩ ১৪৩১
|| ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৮ জানুয়ারি ২০২০
পাঁচ পুরুষ গত। পেশা গত না হলেও হারিয়েছে আগ্রহ। টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় অবিচল রাজশাহীর বাঘার আড়ানী ইউনিয়নের পালপাড়া এলাকার পাল সম্প্রদায়। এলাকার শুরু সময়ের ১০০ পরিবারের মধ্যে টিকেছে মাত্র ২৫ পরিবার। তাদের মধ্যেও কেউ কেউ গেছে অন্য পেশায়।
স্থানীয়রা বলছেন, এক সময় তৈজষপত্রের সবকিছুই মাটির তৈরি ছিলো। কিন্তু তেমন দাম ছিলো না। ফলে অনেক কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। এতে অনেকেই পরিবর্তনও করেছেন পেশা। এছাড়া অল্প সংখ্যক মানুষ এই পেশার সঙ্গে রয়েছে। তবে বর্তমানে মাটির তৈজষপত্রের প্রচলন না থাকলেও মাটির তৈরি মাটির তৈরি রিং (পাট) কদর বেশ কদর বাড়ছে।
এগুলো বিক্রিতে বাজার সৃষ্টি হয়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। এতে করে বিক্রি নিয়ে সমস্যা নেই এই পালদের। বছরের ১০ থেকে ১১ মাস কাজ করতে পারে তারা। তবে বৈশাখ পুরো কাজ বন্ধ থাকে। আর বর্ষায় বৃষ্টির কারণে হয়ে উঠেনা কাজ করা- জানিয়েছেন পালরা।
তারা বলেন, মাটির তৈরি পাট প্রাচীন আমলে কুয়া তৈরিতে ব্যবহার হতো। তবে কুয়ার প্রচলন দিনে দিনে হারিয়ে যাওয়ায় মাটির পাটও কেউ তৈরি করা হতো না। বর্তমানে মাটির তৈরির সেই পাটের কদর বাড়ছে। এখন এই পাটগুলো বেশি কাজে লাগছে টয়লেট তৈরিতে। প্রতিদিন রাজশাহীর কাটাখালী, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাট কিনে নিয়ে যায় পাইকারি দরে।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই প্রতিটি বাড়িতে মাটির কিছু না কিছু পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত তারা। পালরা মাটির হাড়ি, টয়লেটের পাট, পূজার সামগ্রী, গরুর খাবারের চাড়ি (ন্যান) বানাচ্ছেন। এছাড়া তৈরি করা হচ্ছে মাটির সরাই, ঢুকসাও।
এলাকার শ্রী বিধান চন্দ্র পাল বলেন, ‘দাদা, পাঁচ পুরুষের দেখিয়ে যাওয়া পথ। এই পথেই গত হয়েছেন তারা। অন্য কর্মও শিখিনি- যে করে খাবো। কষ্ট হলেও টিকিয়ে রেখিছি কর্মটাকে। তিনি বলেন, এই মৃৎ শিল্পের এখন পর্যন্ত মর্যাদা পেল না। বেশ ভালোই আছিন তারা।
বিলুপ্তপ্রায় এই পেশাটি বেশ যত্নে সাথে রত্ন হিসেবে আগলে রেখেছেন মৃৎ শিল্পীরা। এলাকার ৫০ উর্দ্ধ নারী শ্রী বাসন্তি। বয়সের ভারে নুয়ে গেছেন। তিনি বলেন, এক সময় খেতে পাইনি। এখন তো অনেক ভালো। মাটির হাড়ি- রুটি তৈরির তাওয়া তৈরি করি। এখানেই বিক্রি হয়। নাটোর থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা আসে। তারাই নিয়ে যায়।
জানা গেছে, মাটির পাটগুলো একা তৈরি সম্ভব না। তাই দুজনে মিলে তৈরি করতে হয়। এ পাট ছাট, মাঝারি ও বড় মিলে এক সেট। যা তিনটা মিলে একটি পাট ধরা হয়। যা তৈরির খরচ পরে ৬৫ টাকা। পাটগুলো খুরচা ১৮০ টাকা। পাইকারি ১২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর ছোটগুলো ২০ টাকা কমে বিক্রি হয় বলে জানান শ্রী বিধান চন্দ্র পাল। তিনি আরো বলেন, প্রতি মাসে চারটি ভাটা পুড়ানো হয়। একটি ভাটা থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার পাট বিক্রি করা সম্ভব হয়। যার সবমিলে খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
শ্রী তন্ময় পাল জানায়, ২০০০ সালের দিকে আবার মাটির পাট তৈরি করতে শুরু করে তারা। শুরুর দিকে তেমন চাহিদা না থাকলেও বর্তমানে ব্যাপক। মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়েছি এই পাটগুলো মাটিতে নষ্ট হয় না। টেকে ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত। তার প্রমাণ হিসেবে এখনো দেখা যায় প্রাচীন সময়ের কুয়ার পাটগুলো। এই পাট তৈরিতে মাটি ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করা হয় না।
তিনি আরো বলেন, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জে থেকে পাইকাররা এগুলো কিনতে ভ্যান বা ট্রাক নিয়ে আসেন। তারা এখানে কিনে গাড়িতে তুলে নেয়। এছাড়া আগে থেকে অর্ডার আসে তাদের কাছে।
পালরা জানায়, বর্তমানে মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই দূর থৈকে মাটি কিনে আনতে হয়। এতে করে খরচও বেড়ে যায়। এছাড়া অনেক সময় মাটি খনন করে আনতে দেয় না। তবে কেউ পুকুর খনন করলে সেই মাটি কিনে নেন তারা। তবে অধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। যেমন মাটি কাদা করা হচ্ছে মেশিনে। যে মেশিনের দাম ৬৫ হাজার টাকা। এই মেশিন প্রায় সবার আছে।
মাটির তৈরি পাট কিনতে আসা আশরাফ আলী বলেন, তিনি নাটোর থেকে এসেছেন। এখানে পাইকারি দরে কিনবেন তিনি। এলাকায় তার স্যানাটারি সামগ্রী বিক্রির দোকান আছে। সেখানে তিনি বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, বেশ ভালই বিক্রি হয়। পাটগুলো অনেক দিন মাটির নিচে থাকলেও নষ্ট হয় না। এর ফলে মানুষ সিমেন্টের পাট তেমন কিনছে না টয়লেটের কাজে।
আড়ানী ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক উদ্দিন বলেন, পালপাড়া এলাকাটি ব্রিটিশ আমল থেকে এখানেই আছে। পাল বংশের লোকজনদের জীবিকার মূল উৎস মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য তৈরি ও বিক্রি করা। এখানে বেশির ভাগ পরিবার স্বাবলম্বী। তারা এ কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মানুন উর রশিদ বলেন, মাটির পাট পরিবেশ বান্ধব। এতে সিমেন্ট বালু নেই। এছাড়া খরচও কম।
স/সা
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়