শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||
চৈত্র ১৪ ১৪৩০
|| ১৯ রমজান ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩ এপ্রিল ২০২৩
চাষাবাদ আর খেত খামারে পরিণত হয়েছে পদ্মা নদী। নদীটিতে বছরের নির্দিষ্ট কয়েক মাস পানিতে ভরা থাকে। এরপরে নেমে যায়। এতে বছরের সিংহভাগ সময় ধুধু বালু চর পরে থাকে পদ্মাজুড়ে। একসময়ে চরবাসীর জীবন-জীবিকার উৎস ছিল নদী, নৌকা আর মাছ নিয়ে। তবে কালের বির্বতনে এখন চরবাসীর জীবন-জীবিকা চলছে ক্ষেত খামারে চাষবাদ করে।
সরেজমিনে পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্মার মাঝ নদীতে চর পড়েছে। ফলে নদীর পানির প্রবাহের ধারা কয়েক ভাগে বিভাক্ত হয়েছে। নদীজুড়ে কোথাও পানি, আবার কোথায়ও ধুধু বালু চর। চরগুলোতে বিভিন্ন ফসল ফলানো হচ্ছে। একই সাথে লালনপালন হচ্ছে গবাদী পশু। তবে নদীতে পানি না থাকার কারণে যাতায়াত নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয় চরবাসীদের।
নৌকার মাঝি রুমন বলেন, নদীতে পানি কম। পানি কম থাকার কারণে অনেক দূর দিয়ে ঘুরে নৌকা নিয়ে যেতে হয়। এতে সময়ও বেশি লাগে। খরচও বেশি হয়। আগের মতো নৌকায় ইনকাম (উপার্জন) নাই। আগে দিনে চার থেকে পাঁচ বার যাওয়া আসা করতাম। এখন কমে গেছে। রোজা লাগার পরে মানুষ তেমন পারাপার হচ্ছে না। তবে ১৫ রোজা থেকে মানুষ পারাপার বাড়বে। কারণ মানুষ ঈদের বাজার করতে রাজশাহীতে আসবে।
বছরের আড়াই থেকে তিন মাস পদ্মায় ঠিক মতো পানি থাকে। বাকি সময় ধুধু বালু চর। এই বালু চরে প্রায় ১৩ ধরনের ফসল। মসুর, গম, সরিষা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ছাড়াও ভুট্টা বোরো ধান, পেয়াজের চাষাবাদ হয়। বিশাল এই চাষজজ্ঞের সাথে চরের বিপুল পরিমান জড়িত। চরের এই মানুষ সাধারণত কৃষি পেশার উপরে নির্ভরশীল। আর নদীতে পানি থাকলে মাছ ও নৌকা চালায় আয় হয় তাদের। অনেকেই আবার রাজশাহী শহরে বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত হয়েছেন। তারা শহরে বিভিন্ন দোকানে সেল্সম্যানের কাজ করেন। কেউ কেউ ব্যাটারি চালিত রিক্সা বা অটোরিক্সা চালায়। এছাড়া অনেকেই আবার বিভিন্ন গবাদী পশু পালন করে থাকেন। সেই পশু বিক্রি করে তাদের জীবিকা পরিচালনা করে থাকেন।
অন্যদিকে, রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার জেলে। এরমধ্যে শুধু পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে ১২ হাজার জেলে রয়েছে (নিবন্ধিত)। নদীতে পানি না থাকায় এই জেলেদের বিকল্প হিসেবে জীবিকার তাগিদে অন্য কাজ বেছে নিতে হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন আলী হোসেন। তিনি রাজশাহী নগরীর মিজানের মোড়ের বাসিন্দা। তার পদ্মা নদীতের মাছ ধরে জীবিকা চলে। তবে এখন পদ্মায় পানি না থাকায় তিনি মাছ ধরতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তিনি অটোরিক্সা চালাচ্ছেন।
রাজশাহী জেলা মৎস কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার জেলে। এরমধ্যে শুধু পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে ১২ হাজার জেলে রয়েছে (নিবন্ধিত)। নদীতে পানি না থাকায় এই জেলেদের বিকল্প হিসেবে জীবিকার তাগিদে অন্য কাজ বেছে নিতে হয়েছে। নদী এখন শুকনা। নদীতে মাছে অভাব।
তিনি বলেন, আমরা ৯০ শতাংশ পুকুরে চাষের মাছের উপরে নির্ভরশীল। এখন নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তার পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছে। এগুলো মধ্যে হচ্ছে- নদীতে পানি না থাকা, নদী দুষণ, শহর ও করকারখানা বজ্য, জেলেদের দ্বারা মা মাছ নিধন। মাছ ধরার কাজে জেলেদের অধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার। এইসব কারণে মাছের বংস রক্ষা করা কঠিন হয়ে গেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাজশাহীতে নদী দুষণ হয়। তবে তুলনায় কম।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গেজ রিডার এনামুল হক বলেন, রাজশাহী নগরীর টি-বাধ পয়েন্টে পদ্মার পানি মাপা হয়। শনিবার (১ এপ্রিল) পানি ছিল ৮ দশমিক ৮ মিটার। তার আগের দিন শুক্রবার (৩১ এপ্রিল) ছিল ৮ দশমিক ১২ মিটার। তিনি বলেন, পদ্মার রাজশাহী সিমান্তে ২০ মে থেকে পানি বাড়তে থাকে। আগস্ট, সেপ্টম্বর ও অক্টোবরে পদ্মায় ভরা পানি থাকে। আবার নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পানি কমতে থাকে।
পদ্মা বিস্তীর্ণ চর ফসলী মাঠ
পানিহীন পদ্মার বিস্তীর্ণ চর কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। উর্বার এইচরগুলোতে কৃষি জমি হিসেবে বছেরের অধিকাংশ সময় নানান ফসল ফলে। এতে করে চরের অর্থনীতি স্বচল রয়েছে। নদীতে নৌকা পরিচালনা ছাড়াও চরের মানুষ কৃষি কাজে বেশি অভ্যস্ত। জীবিকার তাগিদে চলের মানুষ দীর্ঘদিন থেকে কৃষি কাজ করে আসছে। তবে বেশি পানি প্রয়োজন এমন ফসল কম হয়।
চরে প্রায় ২০ বিঘা মসুরের চাষ করেছেন মো. সাগর। তিনি প্রতিবছরের মতো এই বছর অন্য সফলের সাথে মসুর চাষ করেছেন। সাগর জানান, চরে ফসলে তেমন খরচ নেই। শুধু চাষ দিয়ে বীজ বপন করতে হয়। এরপরে আর কিছু না করলেও হয়। মাঝে মাছ দেখভাল করতে হয়। গত বছরের তুলনায় এই বছর চরের মসুরে ভালো ফলন হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তার বলছে, রাজশাহীর জেলার আওতায় পদ্মার ১৪টি চর। এ চরের আয়োতন ১৪ হাজার ৮৫৩ হেক্টর। যার মধ্যে আবাদি জমির পরিমান ১০ হাজার ১৮৭ হেক্টর। এরমধ্যে মসুর চাষ হয়েছে ১ হাজার ৫ ২৫ হেক্টর, গম চাষ হয়েছে ২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর, সরিষা চাষ হয়েছে ৩৫০ হেক্টর, শাকসবজি চাষ হয়েছে ১ হাজার ৫৮০ হেক্টর, ভুট্টা চাষ হয়েছে ৬২৫ হেক্টর, বোরো ধান চাষ হয়েছে ৫৫০ হেক্টর, পেয়াজ চাষ হয়েছে ৫১০ হেক্টর, রসুন চাষ হয়েছে ৫৫০ হেক্টর, আল চাষ হয়েছে ৪৮৫ হেক্টর, আম চাষ হয়েছে ৩৪০ হেক্টর, মাসকলাই চাষ হয়েছে ৭২৭ হেক্টর, চিনা বাদাম চাষ হয়েছে ২০০ হেক্টর, ধনিয়াপাতা চাষ হয়েছে ৫০ হেক্টর জমিতে।
বিস্তীর্ণ চরজুড়ে গবাদী পুশু পালন:
পদ্মার বিস্তীর্ণ চরজুড়ে নানা প্রজাতির গবাদি পশু পালন করা হয়। কেউ কেউ বিহত আকারে। কেউ বা বাসা বাড়িতে। তবে চরের প্রতিটি বাড়িতে গরু, মহিষ, ছাগল না থাকলেও হাঁস, মুরগি রয়েছে। হাঁস মুরগির পালন করে চরের মানুষ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রাজশাহী নগরীতে এসে বিক্রি করেন। একইভাবে গরুর দুধও বিক্রি হয় নগরীতে।
এই পদ্মার চরে গরু, মহিষ ও ভেড়াগুলো একেটি পাল আকারে থাকে। একেকটি পালে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০টির অধিক গবাদি পশু থাকে। সেগুলো মাঠে মাঠে খাওয়াতে তিন থেকে পাঁচজন রাখাল নিয়জিত থাকেন। তাদের মধ্যে একজন পবা চরখিদিরপুরে রেজাউল ইসলাম (৪২)। তিনি ছাড়াও পদ্মা নদীর চড়ে গরু, মহিষ, ভেড়াকে খাবার খাওয়াতে নদীতে নিয়ে এসেছেন নাসিম ও শহিদ। তারা তিনজনে ছয়জন মালিকের ১৫০টি গরু, ৬০টি ভেড়া ও ৩টি মহিষ দেখা শোনা করেন।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, রাজশাহীর পদ্মায় চরখিদিরপুর ও চরমাঝারদিয়ারে গবাদিপশু পালন হয়ে থাকে। এরমধ্যে চরমাঝারদিয়ারে গরু রয়েছে ৪ হাজার ৩৩৫টি, মহিষ ১ হাজার ২০৫টি, ভেড়া ১ হাজার ৩৫টি, ছাগল ৭ হাজার, হাঁস ২ হাজার ১০০ ও মরগি ৫ হাজার ৭৫১টি। এছাড়া চরখিদিরপুরে গরু রয়েছে ৪ হাজার ৫৬১টি, মহিষ ৪০৫টি, ভেড়া ১ হাজার ৫১টি, ছাগল ৬ হাজার ১১৩টি, হাঁস ২ হাজার ২১৮ ও মরগি ৫ হাজার ৭৭৫টি।
রাজশাহীতে পদ্মা চরে বিশাল অংশ পবা উপজেলার মধ্যে। এই উপজেলার ছয় নম্বর হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, চরের মানুষের জীবনজিবিকা মূলত গরু, ছাগল পালন করে থাকেন। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামোটি। তবে যারা মাদক ব্যবসা করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। তবে এমন ১০ থেকে ১২ জন রয়েছে। এছাড়া অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এখন নদীতে বেশি পানি নেই। তার পরেও কিছু কিছু জায়গায় পানি রয়েছে। সেই সব জায়গায় মাছ হয়। এছাড়া অনেকেই শহরে (রাজশাহী) এসে ব্যাটারি চালিত রিক্সা, অটোরিক্সা বা ভ্যান চালায়।
পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লসমী চাকমা বলেন, চরের মানুষ মূলত বেশি কৃষি কাজ করেন। তাদের জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন সময় প্রনোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া কৃষি ছাড়াও গবাদি পশু পালন করে থাকেন তারা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি এন্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। পদ্মাকে বাঁচানো খুব জরুরি। নদী ভরাট ও দূষণে মাছসহ অন্যান্য জীবের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ নষ্ট হচ্ছে। নদীতে চর পড়ে যাওয়ায় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। ইতোমধ্যেই নদীগুলো হতে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। নদী বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়