শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ১৩ ১৪৩১
|| ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
বেশির ভাগ কৃষকের গোয়ালে এখন হালের বলদ নেই। চাষ হয় আধুনিক পদ্ধতিতে। ফলে দুই দশক ধরে এ অঞ্চলে জৈব সার উৎপাদনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। জৈব সার না থাকায় বর্তমানে কৃষিজমিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক সারেও আশানুরূপ উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে কৃষকরা জমিতে লবণের ব্যবহার বাড়িয়েছেন। লবণের এই যথেচ্ছ ব্যবহার কৃষিজমি হারিয়ে ফেলছে ঊর্বরাশক্তি। রাজশাহীর সকল উপজেলাতেই একই অবস্থা।
গত কয়েক বছরে রাজশাহীর দুর্গাপুরসহ আশেপাশের এলাকায় কৃষিজমিতে আবাদ বেড়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে ফসল উৎপাদনও বেড়েছে তুলনামূলকভাবে। জমির শ্রেণিভেদে কতক জমিতে বছরে চারটি ফসলও হচ্ছে। কিন্তু অধিক ফলনের আশায় চাষিরা কৃষিজমিতে লবণ, সোডা, হুইল জাতীয় বিষাক্ত পাউডার ব্যবহার করছেন। ফলে কৃষিজমিতে ধীরে ধীরে লবণাক্ততা বাড়ছে। এক সময় এ অঞ্চলের কৃষিজমি Í ঊর্বরাশক্তি হারিয়ে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা।
জানা গেছে, উপজেলার দাওকান্দি, হাটকানপাড়া, জয়নগর, উজানখলসী, হরিরামপুর, দেবীপুর, রাতুগ্রাম, নান্দিগ্রাম, ধরমপুর, শানপুকুরিয়া, বেলঘরিয়া, শ্রীধরপুর, বখতিয়ারপুর, আমগ্রাম, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার জমিগুলোতে প্রচুর পরিমাণ আলু, পেয়াঁজসহ সবজিচাষ হয়ে থাকে। এসব জমিতে কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে জৈব সার ব্যবহার করেন না। জৈব সার সংকটে কৃষকরা শুধুমাত্র রাসায়নিক সার ব্যবহার করে দীর্ঘদিন থেকে আলু ও পেয়াঁজসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে আসছেন। এর ফলে জমির উৎপাদনক্ষমতা কমে গেছে। ফলে বর্তমানে অধিক ফলনের লোভে কৃষিজমিতে যথেচ্ছ লবণ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরে কৃষিজমিতে লবণের ব্যবহার হলেও দিন দিন তা আরও বাড়ছে। এতে এ অঞ্চলের ঊর্বর কৃষিজমি ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। জমিতে লবণ প্রয়োগের ফলে ওইসব জমিতে ২-৩ বছর ফসলের উৎপাদন ভাল হলেও পরবর্তীতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটার উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়বে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই এর বিরূপ প্রভাবে ফসলিজমিতে পানি ধারণ ক্ষমতাও কমতে শুরু করেছে।
উপজেলার ধরমপুর কলেজের কৃষি বিষয়ক প্রভাষক ও কৃষিবিদ দুর্গাদাস প্রামানিক বলেন, এ অঞ্চলের জমিগুলো অত্যন্ত ঊর্বর। কিন্তু চাষিরা দীর্ঘদিন জৈব সার ব্যবহার করেন না। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। এতে ঊর্বর জমিগুলো ক্রমান্বয়ে অনূর্বর হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় চাষিরা উৎপাদন বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর লবণ প্রয়োগ করছেন যা আগামী প্রজন্মের জন্য হুমকি স্বরূপ। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেখা যায় যারা লিজ নিয়ে জমিচাষ করেন, তারাই জমিতে লবণ ব্যবহার করেন বেশি। এভাবে জমিতে লবণের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকলে এ অঞ্চলের জমিগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়বে। এতে কৃষি উৎপাদন ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে।
দুর্গাপুর পৌর এলাকার দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব আলী জানান, আগে বাড়িতে বাড়িতে গোয়াল ভরা গরু ছিল। এতে প্রচুর পরিমাণ গোবর জমা হতো। সেসব গোবর জৈবসার হিসেবে জমিতে ফেলা হতো। ফলে রাসায়নিক সার খুব কম লাগতো। কিন্তু কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি আসায় কৃষকরা খামার ছাড়া আর তেমন বাড়িতে গরু পালন করেন না। বর্তমানে এলাকায় হালের গরু নেই বললেই চলে। ফলে মারাত্মকভাবে জৈব সারের উৎপাদন কমে গেছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমিতে উৎপাদনও কমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার কয়েকজন লবণ ব্যবহারকারি চাষি বলেন, আলু-পেয়াঁজচাষে ব্যাপক টাকা খরচ হয়। তারপরও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। তখন জমিগুলোতে লবণ প্রয়োগ করলে উল্টো ফল দেয়। তারা আরও বলেন, চাষিরা আলু ও পেয়াঁজচাষে ব্যাপক হারে প্রয়োগ করছেন লবণ। আলু ও পেয়াঁজচাষে প্রথমে লবণ ব্যবহার করলে গাছ খুব তরতাজা দেখায়, আবার ফলনও ভাল হয়। লবণের যথেচ্ছ ব্যবহারে মাটি তার ঊর্বরাশক্তি হারাচ্ছে এমন বিষয় চাষিরা স্বীকার করে বলেন, ফসল উৎপাদন খরচের টাকা তুলতে বাধ্য হয়ে তারা জমিতে লবণের ব্যবহার করছেন।
দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান বলেন, কৃষকরা না বুঝে জমিতে লবণ ব্যবহার করছেন। গত বছর উপজেলার মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কৃষকরা যেন জমিতে লবণ ব্যবহার না করেন। তাতেও লবণের ব্যবহার ঠেকানো যায়নি। তবে এবার লবণ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরও বলেন, এই উপজেলার মাটি খুবই ঊর্বর। চাষিরা যদি ভুলক্রমে লবণের ব্যবহার করে, তা হবে খুবই দুঃখজনক। লবণের ব্যবহারে জমি ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে পড়ে। আর এতে পরিবেশ ও আগামী প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়বে। তিনি চাষিদের জমিতে অধিকহারে জৈব সার ব্যবহারের অনুরোধ জানান।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নূরুল ইসলাম বলেন, জমিতে লবণের ব্যবহার করলে জমির ঊর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। ওই জমিতে পরবর্তীতে আর ভালো ফসল হবে না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জমিগুলোতে লবণাক্ততার কারণে ভালো ফসল হয় না। চাষিরা জমির ঊর্বরাশক্তি ঠিক রাখতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে ভালো ফসল ফলানো সম্ভব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহীর উপ-পরিচালক শামছুল হক বলেন, রাজশাহীতে এক সময় পেঁয়াজচাষে লবণ ব্যবহারের কথা শুনেছিলাম। তখন ব্যবস্থা নিয়ে লবণের ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছিল। লবণ জমির ঊর্বরতা শক্তি নষ্ট করে ফেলে। যদি কেউ লবণ ব্যবহার করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিবেন বলে তিনি জানান।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়