রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||
জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১
|| ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারি ২০২২
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ১০টি বিভাগের শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অস্বস্তিতে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সিসি ক্যামেরা থাকা স্বত্বেও যেখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে, সেখানে শ্রেণিকক্ষে ক্যামেরা লাগানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ বিষয়ে বিভাগগুলোকে কোনো নির্দেশনা দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের মার্কেটিং বিভাগ, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, কলা অনুষদের আরবি, ইংরেজি এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, বিজ্ঞান অনুষদের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগ, চারুকলা অনুষদের পেইন্টিং বিভাগ এবং ফিসারিজ অনুষদের ফিসারিজ বিভাগের শ্রেণিকক্ষে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এছাড়াও বেশ কিছু বিভাগ শ্রেণিকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে করোনা মহামারির সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন অনলাইনে ক্লাস চলছিল, তখন শিক্ষার্থীদের ক্লাস রেকর্ড করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। শিক্ষকদের দিক থেকে তখন বলা হয়- সামাজিক, রাজনৈতিক নানান বিষয় নিয়ে ক্লাসে কথা বলতে হয় বলে এসব লেকচার রেকর্ড করা বা প্রকাশ নিরাপদ নয়। ফলে ডিভাইস, নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত অপ্রতুলতায় ক্লাসের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকে বঞ্চিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরা লাগানোর উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে কথা হয় ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীবের সঙ্গে।
তিনি বলেন, এটার কেন প্রয়োজন হলো সেটা আমার কাছে স্পষ্ট না। যেসব বিভাগ ক্যামেরা লাগিয়েছে সেসব বিভাগের সভাপতিরা ভালো বলতে পারবেন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিদেশে বড় বড় সেমিনার বা কনফারেন্সগুলো যেসব গ্যালারিতে হয় সেগুলো ছাড়া লেকচার হলগুলোতে সাধারণত সিসি ক্যামেরা থাকে না।
এসব গ্যালারিতে ক্যামেরা রাখার উদ্দেশ্য অনুষ্ঠানগুলোকে রেকর্ডের আওতায় রাখা। এখানে জানা দরকার কী উদ্দেশ্যে তারা লাগিয়েছেন? শিক্ষার্থীদেরকে অবহিত করা হয়েছে কি না? এটা স্কুলে স্বাভাবিক যে, সেখানে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মারামারি হতে পারে। সেটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযোজ্য নয়। এর উদ্দেশ্যটা শিক্ষার্থীদের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার, নইলে একটা অস্বস্তি তৈরি হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার মন্ডল বলেন, সিসি ক্যামেরা বিভাগের নিরাপত্তা এবং শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্য লাগানো হয়েছে। আরও কয়েকটি বিভাগেও লাগানো হয়েছে। এটা সবার ভালোর জন্য লাগানো হয়েছে। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে লাগিয়েছি। আমার বিভাগের সবাই এটাকে ভালো মনে করছে।
তবে বিভাগটির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কখনো আলোচনা করেনি বিভাগ। সিসি ক্যামেরা নিয়ে বিভাগ বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এই বিভাগ থেকেই। শিক্ষার্থীদের দাবি- বিভিন্ন সময়ে সিসি টিভি ক্যামেরা ব্যবহার করে তাদের ওপর নজরদারি করা হয়। তবে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি কোনো শিক্ষার্থী।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিসি ক্যামেরা লাগানোয় সার্বক্ষণিক একটা চাপ কাজ করে। আমার ওপর একটা চোখ সব সময় নজর রাখলে আমি তো নিজের মতো করে মুভ করতে পারব না। আমরা কি স্কুলে পড়ি যে মারামারি করব? বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক কেন চোর-পুলিশের মতো হবে? শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে কীসের নিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে?
এদিকে সিসি ক্যামেরায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নজর রাখা হয় শিক্ষকদের কার্যক্রমেও। বিষয়টি ফুটে ওঠে মার্কেটিং বিভাগের সভাপতির কথায়। বিভাগটির সভাপতি অধ্যাপক ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন,পরীক্ষার সময় ডিউটি ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, শিক্ষকরা সময় মতো ক্লাসে আসছে কিনা, অনেক ক্লাস রুটিনে থাকলেও ঠিকঠাক হয়না এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ও শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্যই সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এখানে নিরাপত্তার ইস্যু অবশ্যই আছে। আজ থেকে ৫-৭ বছর আগে তখনকার সভাপতি একাডেমিক কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ক্যামেরা লাগিয়ে ছিলেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী প্রসেনজিৎ কুমার বলেন, আমি সবসময় শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরা লাগানোর বিপক্ষে। শুধু শিক্ষার্থীদের নজরদারি না করে, শিক্ষকদের ক্লাসগুলো ভিডিও করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। তাহলে মানুষ বিচার করতে পারতো। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে বসে থাকতে বাধ্য করার জন্য এসব আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে আরবি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুদ্দিন শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়নি জানালেও ওই বিভাগের ৩০৪ নম্বর রুমে সিসি ক্যামেরার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের মনিটরিং বিব্রতকর উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাদিকুল ইসলাম সাগর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটা মুক্তচিন্তার জায়গা। এই পরিসরে শ্রেণিকক্ষে এ ধরনের নজরদারি আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি না।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশে শিক্ষকদের কাজ-কর্ম কী হবে সেটা স্পষ্ট করে লিখে দেওয়া হয়নি, কারণ এখানে মুক্তচর্চার মানুষরা থাকবে, কাগজে কলমে লিখে দিয়ে সেটা প্রয়োগ করার কিছু নেই। শিক্ষকরা ঠিকঠাক ক্লাস নিচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং খুবই বিব্রতকর একটা ব্যাপার।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, এখানে ছাত্র-শিক্ষক, বিভাগের সকলেরই স্বাধীনতা আছে। এসব বিভাগ কী উদ্দেশ্যে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে সেটা তারা জানে। যেসব বিভাগে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, সেসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানাক। তারা যদি শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো অমান্য করে তাহলে আমরা অবশ্যই কথা বলব এটা নিয়ে।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়