রোববার ০১ অক্টোবর ২০২৩ ||
আশ্বিন ১৫ ১৪৩০
|| ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৪ জানুয়ারি ২০২৩
চুলায় দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। সেদ্ধ ধানের ভাপে ডুবে যাচ্ছে রীতা লাকড়ার মুখ। চোখ পিট পিট করে অনেকটা হাতের আন্দাজেই কড়াই থেকে কুলার ওপর গরম ধান তুলে নিচ্ছেন। এরপর কুলা ভরে গেলে পাশে জমিয়ে রাখা ঠান্ডা পানিতে ফেলছেন। পরদিন সকালে আবার সেই ধান সেদ্ধ করবেন।
চুলায় লাকড়ি ঠেলতে ঠেলতে প্রতিমনি খালকো (৬০) বললেন, ‘হামনিকের তো ফ্রিজ নাইখে। এখে সারা দিন খাইলা।’ অর্থাৎ তাঁদের ফ্রিজ নেই। তাই এ ভাতই তাঁরা সারা দিন খান। এ জন্য এই ধান দুবার সেদ্ধ করতে হয়। একে ‘দোসিদ্ধ’ ধান বলা হয়।
সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মালমপাড়া ওঁরাও পল্লিতে গিয়ে ধান নিয়ে তাঁদের লড়াইয়ের কথা জানা গেল। ওঁরাও পল্লির বাসিন্দাদের নিজের কোনো জমি নেই। তাঁরা সবাই অন্যের জমির ধান কেটে দিয়ে ‘জিন’ (পারিশ্রমিক) হিসেবে এ ধান পান।
রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ীহাট। সেখান থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর দিকে গেলে রাস্তার বাঁ দিকে মালমপাড়া ওঁরাও পল্লি। ঢোকার পথেই একটি তালগাছ। ডান পাশে একটি বড় পুকুর। কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই ধানের কারবার চোখে পড়ে। থরে থরে সাজানো ধানের খড়। পাশেই বাঁধা আছে গরু।
সেখানে তখন চলছে ধান সেদ্ধ করার ধুম। এ যেন ছবির মতো দৃশ্য। শীতের মধ্যে প্রায় উন্মুক্ত শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিশুরা। এর মধ্যে এক শিশুর গায়ে একখানা গামছা জড়িয়ে দেওয়া। বোঝা গেল, শীত নিয়ে তাঁদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁরা ব্যস্ত আছেন ধান নিয়ে।
প্রতিমনি খালকো চুলায় লাকড়ি ঠেলতে ঠেলতে কথা বলছিলেন। তাঁর চুলার পাশে ১০ মণ ধান ধরার মতো একটি চৌবাচ্চা। এর ভেতরে পলিথিন দিয়ে ঠান্ডা পানি ঢেলে রাখা হয়েছে। একবার সেদ্ধ করা ধান তুলে ওই পানিতে রাখা হয়। কথা বলতে বলতেই রীতা লাকড়া (৩৫) ও রূমপা খালকো (৩২) এলেন। তাঁরা এসেই জ্বলন্ত কড়াই থেকে ধান তুলে পাশের পানিতে রাখতে লাগলেন।
প্রতিমনি খালকো বলেন, এই ধান সারা রাত পানিতে থাকবে। সকালে আবার এভাবে চুলায় সেদ্ধ করা হবে। তারপর শুকিয়ে চাল করা হবে। সেই চালের ভাত সহজে নষ্ট হয় না। খেতেও মিষ্টি। তারা সকালে একবার রান্না করে মাঠে নিয়ে যান। বাড়িতে রেখে যান। তবে একবার সেদ্ধ ধানের ভাত এতক্ষণ থাকে না। নষ্ট হয়ে যায়।
ধান সেদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত নারীরা জানালেন, অন্যের জমির ধান কেটে দিয়ে যেটুকু ‘জিন’ পান, তা-ই দিয়ে সংসার চালাতে হয়। এ জন্য এই ধানের এত যত্ন নিতে হয়।
পুরো পল্লি ঘুরে দেখা গেল, বাড়ির পাশের মাঠে সেই ধান নিয়ে পল্লির নারীরাই ব্যস্ত। পুরুষেরা বাইরে থেকে এসে রোদে গা এলিয়ে বসে আছেন। গ্রামের যুবক রাজকুমার লাকড়া বললেন, এই পল্লির ১৫ ঘরে ওঁরাও জাতির লোকজন বাস করে। তাঁদের নিজের কোনো জমি নেই। তাঁদের বাড়ির ভিটে ছাড়া সব জমি রাজশাহীর মানুষের।
amarrajshahi.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়